top of page

স্বীকৃতি পত্র #২

  • Writer: Abhijit Chakraborty
    Abhijit Chakraborty
  • May 15, 2022
  • 6 min read

ree

রাতের খাবার টেবিলে অস্বস্তির নিস্তব্ধতা।


বাবার পরাজয় টা কিছুতেই মেনে নেওয়া যাচ্ছে না । বাবা তো সে ভাবে কোনো চেষ্টা ই করলো না । মাসীর সাথে মায়ের মহাজোট বাবাকে এইভাবে কোণঠাসা করে দিল ! বাবা কি শুধু তাহলে মায়ের কথাই ভাবলো, ওর কষ্ট টা একটুও বুঝতে পারলো না !


-"নিজের ছেলে এই রকম মাঝ পথে ইঞ্জিনিয়ারিং ছেড়ে আর্টিস্ট হতে চাইলে তুমি মেনে নিতে? দিদির ছেলে কে একটু নিজের ছেলে বলে ভাবতে কি খুব কষ্ট হয়? তোমাদের মতন স্বার্থপর মানুষ গুলোর সাথে একসাথে এতদিন কি করে কাটাচ্ছি সেটা ভাবতেই অবাক লাগে' - আগ্নেয়গিরি থেকে লাভা বেরোচ্ছে রুনার মুখ দিয়ে। স্বপ্নীল জানে আজকে ওর মুখ খোলা মানে ঘরে তাণ্ডব নৃত্য হবে। একদিকে মেয়ের মন-খারাপ অন্য দিকে বউয়ের মেজাজ , স্বপ্নীল জানে কোনোটাই ঠিক করার কোনো ক্ষমতা এই মুহূর্তে ওর কাছে নেই। তাই চুপ করে থাকা টাই শ্রেয়।


খাওয়া শেষ করে দোতলার নিজের ঘরে এসে একটা সিগারেট ধরিয়ে মা-মেয়ের চিন্তা থেকে নিজেকে সরিয়ে আনার চেষ্টা করাটাই এখন বুদ্ধিমানের কাজ। কেসটা কে নিয়ে সে ভাবে আজ সারাদিন কিছু ভাবতেই পারা যায় নি। গতকালকে নিশীথ বাবুর বাড়ি থেকে চিঠিগুলো নিয়ে এসেছে কিন্তু পড়ার সময় পায় নি। নিশীথ বাবুর স্ত্রী প্রমিতা দেবীর কাছ থেকে পাওয়া তথ্য গুলো ইনভেস্টিগেশন অ্যানালিসিস সিস্টেমে এন্ট্রি করতে সারারাত চলে গেছিল। তথ্যপ্রযুক্তির দৌলতে এটা এখন বেশ সুবিধা হয়েছে - কম্পিউটার নিজের মতন বিশ্লেষণ করে ভালো কিছু সুপারিশও করে। এই যেমন নিশীথ বাবুর অস্বাভাবিক মৃত্যুর সম্ভাব্য কারণ আত্মহত্যা বলেই নির্ধারণের সুপারিশ এসেছে। শহরে আত্মহত্যার হার বেড়ে চলা, বর্তমান সার্বিক পরিস্থিতি আর ডিপার্টমেন্টে কুশল অফিসারের অভাব - ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষ থেকে স্বপ্নীলের উপর চাপও বাড়ছে কেস টা বন্ধ করে দেবার অথবা খুব তাড়াতাড়ি অপরাধীকে খুঁজে চার্জশিট দাখিল করার।


এর আগেও বেশ কয়েকবার এই রকম পরিস্থিতি এসেছে যখন স্বপ্নীল চ্যাটার্জী নিজের ষষ্ঠ ইন্দ্রিয়ের ডাকে সাড়া দিয়ে নিজের নামের সুবিচার পেয়েছে। কেন জানি না, এই বারেও সেই রকম অনুভুতি হচ্ছে কিন্তু চোখের সামনে কোনো রাস্তা পাচ্ছে না।


চিঠির তোড়া গুলো কে এক সাথে দেখে বারে বারে মনে হচ্ছে , এর মধ্যেই আছে অপরাধীর কাছে পৌঁছে যাবার চাবিকাঠি। প্রত্যেকটা খামের উপর প্রাপকের নাম ও ঠিকানা। কোনো ডাক টিকিট লাগানো নেই। চিঠি লিখে পোস্ট না করার কারণ টা কি? এখনকার দিনে চিঠি লেখা মানে তো ই-মেল । সাবেকি ঐতিহ্য কে ধরে রাখার প্রাণপণ প্রচেষ্টা না কি উনি চেয়েছিলেন যে ওনার আত্মহত্যার পর এই চিঠি গুলো পড়া হোক আর এই চিঠির সূত্র ধরে উনি কিছু জানাতে চান।


নিশীথ বাবুর হাতের লেখার তারিফ না করে উপায় নেই। ফাউন্টেন পেনের কালো কালিতে নিশীথ বাবুর নিজস্ব লেটার প্যাডে লেখা চিঠিগুলোর আভিজাত্যে স্বপ্নীল মুগ্ধ । ছোটবেলায় বাড়ির লেটার বক্সে উঁকি দেওয়া নীল ইনল্যান্ড আর হলুদ পোস্ট কার্ডের দিনগুলো চোখের সামনে ভাসছে । নাহ্, এখন স্মৃতির সরণী তে ডুব দেবার সময় নয় । চিঠি গুলো কে আগে আদ্যপান্ত পড়তে হবে, তারপর বাকি ভাবনা ।


প্রথম খামের চিঠির প্রাপক - শ্রীযুক্ত সুবিমল সিনহা , ২১/৪ বনমালী নস্কর লেন, বিজয়গড়, কলকাতা - ৭০০০৩২।


প্রিয় সুবিমল,

অনেক দিন ধরেই তোর সাথে একটা বিষয় নিয়ে আলোচনা করবো বলে ভাবছিলাম কিন্তু বিভিন্ন অকাজের মধ্যে ব্যস্ত থাকাতে কথাটা বলে উঠতে পারছিলাম না। বিগত কয়েকদিন ধরে এটা ভাবার চেষ্ঠা করছিলাম যে পরজন্ম বলে কি কিছু হয়? হিন্দু, বৌদ্ধ আর জৈন ধর্ম ছাড়া এই জন্মান্তর আর আত্মার মুক্তির পথের কথা আর তো কোথাও নেই । একেশ্বরবাদী খ্রীষ্ট আর ইসলাম ধর্মে তো মৃত্যুই শেষ কথা। যদি এই বিশ্বের সৃষ্টি কর্তা একজন ই হয়, তাহলে মৃত্যুর পর ধর্মের ভিত্তিতে পথ আলাদা হয় কি করে?


হটাৎ করে জানতে পারলাম গত শতাব্দীর সাতের দশকে , হেলেন ওরামবাক বলে একজন মনস্তত্ত্ববিদ আমেরিকায় এক সমীক্ষা চালান প্রায় সাতশ মানুষের উপর। সম্মোহনের সাহায্যে ওই মানুষ গুলোর সামনে বেশ কিছু প্রশ্ন করা হয় তাদের পূর্বজন্ম সম্বন্ধে। এবং প্রায় ৮১ শতাংশ মানুষ স্বীকার করেন যে তাঁদের আগের জন্মের অস্তিত্বের কথা। শুধু তাই নয়, এই জন্মের পরিচিত মানুষরাই তাদের আগের জন্মে অন্য পরিচয়ে দেখতে পান। এই জন্মের স্ত্রী কে গত জন্মের মা রূপে আবার গত জন্মের জেলের আসামী এই জন্মে গত জন্মের জেলের কারারক্ষীর ছেলে রূপে ।


অবিনশ্বর আত্মার অস্তিত্ব ই কি এই সমীক্ষার মূল প্রতিপাদ্য। সৃষ্টির রহস্য উদঘাটন করার জন্যে কি তাহলে পাশ্চাত্য সমাজ প্রাচ্যের কর্মফল আর আত্মার এক আধার থেকে অন্য আধারের স্থানান্তরের উপপাদ্য কে স্বীকার করে নিয়েছে?


ভালো থাকিস। খুব তাড়াতাড়ি দেখা হবে।


ইতি

নিশীথ


এক নিঃশ্বাসে চিঠি টা পড়ে উঠে নিজের খাতায় কয়েকটা শব্দ লিখে নিল । নাস্তিক / ধার্মিক , বিজ্ঞানী , আত্মার মুক্তি, বন্ধু / অনুজ, মৃত্যু খোঁজ । চিঠি টা কবে লেখা হয়েছে সেটার সমন্ধে কোনো স্থির ধারণা পাওয়া গেল না, কারণ চিঠির শুরুর দিকে ডান কোণে একটা তারিখ আছে, ৭ই ডিসেম্বর কিন্তু কোনো সালের উল্লেখ নেই। চিঠিটা যত্ন করে ভাঁজ করে খামের ভিতর ঢুকিয়ে দ্বিতীয় চিঠি টা খুলে ফেললো। এই খামের উপর প্রাপকের কোনো নাম ঠিকানা নেই।


শ্রীচরনেষু বাবা,

পরশু দিন সকালে বইয়ের আলমারি ঘাটতে ঘাটতে তোমার ডায়েরি টা খুঁজে পেলাম। হলুদ পাতার গন্ধে তোমাকে যেন ছুয়ে আছি মনে হচ্ছে । গত দু-দিন তোমাকে নিয়েই রয়েছি, তোমার লেখা প্রতিটা ছত্রে তোমাকে নতুন করে আবিষ্কার করছি। শরীর চর্চা টা নতুন করে শুরু করবো ঠিক করেছি। জানি না, এই বয়সে কেদারনাথ পুরো হেঁটে যাবার সিদ্ধান্ত টা ঠিক কি না! আশা করছি পারবো।


মানুষের কল্যাণে ধর্মের ভূমিকা নিয়ে আমি তোমার সাথে একমত, কিন্তু ধর্মের ঢাল মানুষ কতদিন ব্যবহার করবে সেটা নিয়ে মনে হলো তোমার সাথে আমার একটু আলোচনার প্রয়োজন আছে। হিন্দু ধর্মের মূর্তি পূজো নিয়ে পাশ্চাত্য সমাজের সমালোচনা করতে দেখে খুব অবাক লাগে। খ্রীষ্ট ধর্মের অনুগামীরা তাহলে কেন চার্চে গিয়ে প্রভু যীশুর সামনে নিজেকে অঞ্জলি দেয় ? মনে প্রশ্ন জাগে, ইসলাম ধর্মের মানুষরা যখন নামাজ পরে তখন তারা সর্বশক্তিমান আল্লাহ কে কি রূপে গ্রহণ করে?


ভালোবাসার মানুষের মধ্যে সৃষ্টির উপাসনা করার কথা প্রাচীন কাল থেকে মহিষীরা বলে গেছেন কিন্তু উপাসনা করার কি কোনো প্রয়োজন আছে? মৃত্যুর পরে যদি আত্মার কোনো অস্তিত্ব না থাকে তাহলে উপাসনা করার দরকার কি? ইহজীবনে শরীর যদি শেষ কথা বলে গণ্য করা হয় তাহলে শুধু শরীরচর্চা ই করা উচিত। অঙ্গ প্রত্যঙ্গের স্বাভাবিক কাজে উপাসনার উপকারিতা নিয়ে তাহলে মানুষকে আরো সজাগ করাই তাহলে ধর্মের আশু কর্ত্তব্য হওয়া উচিত ছিল।


তোমাকে আরো চেনার অপেক্ষায় দিন গুনছি।


ইতি

নিশু


প্রত্যেক বাবা মায়ের কাছে তাদের ছেলে মেয়েদের একটা ছোট আদরের নাম থাকে । স্বপ্নীলের মুখে একটা হালকা হাসির ছোয়া ছড়িয়ে যায় মণির কথা ভেবে। মণি ওরফে এষানি, ওদের চোখের মণি।


যে মানুষটা সামনের বছর কেদারনাথ যাবে ঠিক করে শরীরচর্চা শুরু করে সে কি ভাবে আত্মহত্যা করতে পারে, যদি না এই চিঠি টা খুব পুরনো হয়। কিন্তু চিঠির পাতার ঔজ্জ্বল্য বলছে চিঠির বয়স খুব বেশি হলে মাস খানেক। তাহলে এটা একটা বড় প্রমাণ হতে পারে ওর ষষ্ঠ ইন্দ্রিয়ের সপক্ষে। চিঠি টা খামে ঢোকানোর আগে নিজের খাতায় আরো কিছু শব্দ যোগ করে নিল। কেদারনাথ , পাশ্চাত্য বিরোধ? , আত্মা নিয়ে আগ্রহ ।


প্রায় সাড়ে বারোটা বাজে। আজ সহজে ঘুম আসবে না। কিন্তু সব কটা চিঠি আজ আর পড়া বোধহয় ঠিক হবে না। ভাবনাগুলোর উধোর পিন্ডি বুধোর গায়ে হবার সম্ভাবনা বেড়ে যাবে। নিজের দেওয়া বাঁধন ভেঙে কোন এক নেশার টানে তৃতীয় চিঠি টাও খুলে ফেললো স্বপ্নীল।


প্রিয় মাধুরী,

প্রথমেই তোমাকে জানাই অনেক অনেক অভিনন্দন। নতুন করে তোমার কাজের প্রশংসা করা হয়তো আমার মুখে শোভা পায় না। তাও তোমার কাজের একজন গুণমুগ্ধ ভক্ত ভেবে আমার অভিনন্দন গ্রহণ কোরো।


আমাদের স্বল্প পরিচিতির স্মৃতির ধুলো সরিয়ে, পুরোনো দিনগুলোর কথা ভাবতে বেশ ভালো লাগছিলো । ভাবলাম সেই আবেশকে আর একটু এগিয়ে নিয়ে যেতে তোমার সাথে একটু গল্প করি। ভাবছ, বুড়ো বয়সের ভিমরতি। আমার কাছে বয়েস শুধু একটা সংখ্যা। পঁচিশের তরতাজা যুবকের মধ্যে যেমন অশীতিপর ইচ্ছে ভর করে থাকতে পারে তেমনি সত্তরের দরজায় টোকা দেওয়া মনও তেজী ঘোড়ার উশৃঙ্খল সওয়ারি হবার জন্য প্রস্তুত থাকে। সুন্দরী নারীদের সাথে আলাপ জমাতে বোধহয় সব পুরুষই আগ্রহী।জীবনের উপান্তে এসে নতুন করে কোনো মানুষ কে চিনতে শেখা একটু দুরুহ হলেও বেশ রোমাঞ্চকর ।


সফলতা ও ব্যর্থতা জীবনের এদিক আর ওদিক। জিনের গোপন সংকেত খুঁজে পাবার অসীম আনন্দের মতনই আরও একটি আনন্দ আছে। নিজের ভুল স্বীকারের আনন্দ। আর সেই ভুল স্বীকার যদি কোনো অবিচারের প্রায়শ্চিত্ত হয় তাহলে সেটা ঈশ্বর লাভের সমান।


ভালো থেকো।


ইতি

নিশীথ সেন।


স্বপ্নীলের আর কোনো সংশয় নেই। এটা কোনো স্বাভাবিক আত্মহত্যা হতে পারে না। প্রাণবন্ত এই রকম মানুষ হটাৎ করে এই বয়সে নারী ঘটিত কোনো কেলেঙ্কারি তে নিজেকে ফাঁসিয়ে ফেললে অবশ্য অন্য কথা। ভদ্র সমাজে নিজের মান সন্মান কে বাঁচানোর থেকে বড় দায় কিছু নেই - সে যতই নিজের মনের ইচ্ছের বিরুদ্ধে হোক না কেন। নিশীথ বাবুর মহিলা কেন্দ্রিক জীবন সমন্ধে একটু খোঁজ নেওয়াটা দরকার। চিঠি টা ভালো করে আরো একবার পড়ে নিল খামে ঢোকানোর আগে। প্রাপকের নাম ও ঠিকানা - মাধুরী দাশগুপ্ত , শিবালিক অ্যাপার্টমেন্ট, ১২৩ বৈষ্ণবঘাটা মেইন রোড, কলকাতা - ৭০০০৯৪ ।


বাকি চিঠি গুলোর পড়ার আপাতত দরকার নেই। কালকে সকালে অনেক গুলো কাজ আছে । অফিস, বৈষ্ণবঘাটা আর একবার প্রমিতা দেবীর সাথে দেখা করতে হবে। শেষের চিঠিটা দিনের শেষে সোনালী বিন্দুর মতন। অন্ধকার টানেল শেষে দেখতে পাওয়া এক বিন্দু আলোর ঝিকমিক।


ঘরের দরজা টা বন্ধ করে শোবার ঘরে যাবার আগে মোবাইল টা খুলতে মন টা আরো ভালো হয়ে গেল। প্রিয় মানুষের থেকে শুভ রাত্রি ও তাঁর সাথে মানানসই ইমোজি - সারাদিনের তেতো থাকা মন মাধবীলতার গন্ধে ভরপুর হয়ে উঠলো।


(চলবে)




Comments


©2020 by Hizibizi Online

bottom of page