top of page

প্রতিবিম্ব # ৬

  • Writer: Abhijit Chakraborty
    Abhijit Chakraborty
  • Apr 1, 2020
  • 10 min read

ree

উৎসবের আমেজটা মেঘলা রবিবারের সকালের ঘুমের মতন। আরো একটু জড়িয়ে থাকতে ভালোলাগে। উৎসবের পরিধি বেড়েই চলেছে, পাল্লা দিয়ে কাজের জগতে ফিরতে চাওয়া ঢিলেঢালা ভাব। পূজো ও তার পরবর্তী দিনগুলোতে মানুষের শরীর-মন বোধহয় দুটোই বেশ চনমনে থাকে আর আমার চেম্বারও তাই ফাঁকা ফাঁকা। পড়ে পাওয়া চোদ্দআনা সন্ধ্যেগুলোতে আত্মীয়-স্বজনের বাড়িতে বিজয়া করতে যাবার সুপ্ত ইচ্ছা মুখ ফুটে বলা এখন বারণ। না বলে হটাৎ করে কারুর বাড়িতে হাজির হওয়ার আনন্দ সামাজিক প্রেক্ষাপটে বিলুপ্তির পথে। ফাঁকা চেম্বার বন্ধ করে নিখিলকে ছুটি দিতে চাইলেও দেওয়া উচিত নয় - নিখিলের ও একটা এলিব্যাই থাকা দরকার বিজয়া না করতে যাবার।

আজ একটু ব্যতিক্রম হলে কি খুব অসুবিধা হবে! গিন্নি বাপের বাড়ি ছেলেকে নিয়ে। ফিরতেও পারে আবার নাও পারে। নাহ, আমার বিরুদ্ধে আপাততঃ কোনো চার্জশিট দাখিল হয় নি। ফিরে না আসার হুমকি অবশ্য মাঝেই মাঝেই হুল ফোটায়। আজ অবশ্য মনের আনন্দে ভাই-এর কুশল কামনায় ফোঁটা দিতে গেছে। মিঠির বাড়িতে গতকাল প্রতিপদে আমার ফোঁটা নেওয়া হয়ে গেছে তাই আজ অনেকটা ফাঁকা সন্ধ্যে আমার হাতে। নিখিলকে চেম্বার বন্ধ করতে বলে আমিও বেশ ঝাড়া হাত পা হয়ে নিলাম। সময়ের আগে ছুটি পেয়ে নিখিল-ও বেশ খুশি। এই ছোট ছোট খুশি গুলো ছুঁতে আর দেখতে খুব ভালো লাগে। সবই দীক্ষাগুরু'র আশীর্বাদ।

অনেকদিন উদ্দেশ্যেহীন ভাবে কলকাতার অলি-গলিতে ঘোরা হয় না। অচেনা পাড়ার সরু গলি আর গলির কর্নার প্লটের বাড়ি গুলোর হাতছানি। উত্তর কলকাতার অলি-গলি তে ঘুরে বেড়ানোর নেশাও দীক্ষা গুরুর হাত ধরে। সরকারি হসপিটালে হাউস স্টাফশিপ আর তার সাথে এম.ডি প্রবেশিকা পরীক্ষার গন্ডি পার করার চাপে আমি তখন দিশাহারা। প্রেমটাও নড়বড় করছে সময় দিতে না পারার অজুহাতে। প্রায়শই দু-তিন রাত টানা জাগতে হয় হসপিটালে, তাঁর মধ্যেই পড়ার চেষ্টা। কেমন যেন হাঁপিয়ে উঠেছি। মেসোর সাথে দেখাও  হয় না বিশেষ।
মেডিকেল কলেজের কিছু বন্ধু মাঝে মাঝে আসে বাড়িতে - সামাজিক অবক্ষয়, সাহিত্য, বাপি বাড়ি যা, রাজনৈতিক মতামত নিয়ে বাড়ির দুধ চায়ে তুফান ও ওঠে। (বাঙালির স্বাস্থ্য সচেতনতার লাল চা বাড়ির চৌকাঠ পেরোয় নি)। সময়ের সাথে সবই চলছে ঘড়ি ধরে, কিন্তু কেন জানি না নিজের মনকে বুঝতে পারছি না। নিজের মনের অন্ধ গলিতে বারবার হোঁচট খাচ্ছি। নিজেকে চেনার চেষ্টা কি ভাবে শুরু করবো সেটাও শীতের কুয়াশার মতন অস্পষ্ট। পৌষানীর সাথে সম্পর্ক টাও তিতকুটে হতে শুরু হয়েছে। প্রেমের আবেগ, রোমাঞ্চ মধ্যবিত্তের মাসের শেষের ম্যানিব্যাগের মতন তলানিতে। 

৪৮ ঘন্টা টানা ডিউটি করে রবিবারের দুপুরে ভাতঘুম দিচ্ছি। ভেজানো দরজা খুলে কলকাতা ভ্ৰমনের প্রস্তাব মেসোর। দরদস্তুর করেও রেহাই পেলাম না। এবার আর ট্যাক্সি নয়। হাজরা থেকে 2বি বাসের দোতলায় বসে মেসোর প্রশ্ন
-"নিজেকে নিয়ে ভাবাটা তোর কাছে কতটা ইম্পরট্যান্ট?"
বোকাবোকা প্রশ্নের উত্তর দেবার কোনো মুচলেখা দেওয়া নেই। শরীর থেকে ঘুমটা যায় নি, মেজাজ টাও চিরচিরে।
-"নিজের মন কেও যদি চিনতে না শিখলি তাহলে তোর ভাবনা গুলোকে ঠিকঠাক জায়গাতে নিয়ে যাবি কি করে?"
-"মন কে চেনা কি অত সহজ নাকি?"
-"কোনো কিছুই সহজ নয়। ওয়ান- টু -ওয়ান পজিশনে স্ট্রাইকার কোন দিকে বলটা প্লেস করবে সেটাও বোঝা সহজ নয়।গোলকিপার কোন দিকে বডি ফেলবে সেটাও স্ট্রাইকার কি সহজে বুঝতে পারে?"
-"জীবনের সব কিছু ফুটবল নয় মেসো" - গলাটা গম্ভীর করে বোঝানোর চেষ্টা যে আমি এখন প্রাপ্তবয়স্ক যুবক। আমারও কিছু  নিজস্ব মতামত আছে।
-"ভালো বলেছিস, জীবনটা ফুটবলের মতন টানটান উত্তেজনাপূর্ন নয়। একঘেয়েমি, নিস্তরঙ্গ ড্র করা খেলাও হতে পারে।" 

মেসোর চোখটা কেমন এক উদাসীনতাতে ভরে গেল। আমি ইচ্ছা করে মেসোকে কষ্ট দিতে চাই নি। কি কথা বলে মেসোকে আবার ফিরিয়ে আনবো , সেটাও ছাই মাথায় আসে না। বাসের দোতলা থেকে কলকাতার বিকেলের ম্লান মুখ দেখা ছাড়া আর কিছু করার থাকলো না।

-"তোর ক্ষিদে পাচ্ছে না?"
-"হ্যাঁ, বেশ ক্ষিদে ক্ষিদে পাচ্ছে। " - আমার খেতে ইচ্ছে নেই, তাও মেসোকে আর কষ্ট দেওয়া যাবে না।"

গোলবাড়ির কষা মাংস ও পরোটা খেতে খেতে মনে হল ক্ষিদে টা ভেতরে ছিল। মনটা বেশ ফুরফুরে লাগছে। রসনা তৃপ্তির সাথে ফুরফুরে মনের যোগাযোগ বোধহয় সৃষ্টি রহস্যের সেই আপেল খাবার দিন থেকেই।  উদ্দেশ্যেহীন ভাবে হেঁটে যেতেও যে এত ভালোলাগে সেদিন আবিষ্কার করলাম। শান্তি ঘোষ স্ট্রিট, দুর্গা চরণ মুখার্জি স্ট্রিট, নিবেদিতা লেন, বাগবাজার স্ট্রিট হয়ে বাগবাজার ঘাট। ভরা সন্ধ্যের নির্মোহ,নিস্তব্ধ,স্থিত গঙ্গার এই রূপ আমি কখনো দেখি নি। আধো-অন্ধকার ঘাটে নিয়নবাতির প্রতিফলন ও তাঁর সাথে শিরশিরে হাওয়ায় মনের দূষণ মুক্ত হচ্ছে। 

-"জানিস, আমার যখন মন খারাপ করে তখন আমি এই ঘাটে এসে বসি।"
-"তোমারও মন খারাপ হয়?"

হাসিতে ফেটে পড়েছে মেসো। আমার প্রশ্ন শুনে। ছোঁয়াচে হাসিতে আমিও হাসছি। শরীর টা খুব হালকা লাগছে। এই রকম কেন সবসময় হাসতে পারি না! তাহলে তো মনের দমবন্ধ কষ্ট টা আর থাকে না।

-"আচ্ছা মেসো, নিজের মনকে কি সত্যি চেনা যায়?"
-"বিলে তো বিবেকানন্দ হয়ে ছিল জ্ঞানের চোখ দিয়ে, তাহলে তুই সামান্য নিজের মনকে চিনতে পারবি না তোর জ্ঞান দিয়ে?"
-"কিন্তু পারছি কই?"
-"কেন পারছিস না?- এ তো মহাঝামেলা। ডিম আর মুরগির সাইক্লিক লুপে পরে গেলাম।

-"মন তো শরীরেই একটা অঙ্গ। কি তাই তো? ডাক্তারের পাশে বসে তো শরীর নিয়ে কোন ভুল বলা যাবে না।"
-"হ্যাঁ, তাতে কি হলো?"
-"তাতে কিছুই হয় নি, শুধু এইটুকু মনে করালাম।"
-"একটু সহজ করে বললে বুঝতে পারি।"
-"তুই তো নিজের মনের খোঁজ করছিস কিন্তু পারছিস না। তোর মতন নিশ্চয়ই আরো অনেক মানুষ এই মনের ভুলভুলাইয়া তে হারিয়ে যাচ্ছে প্রতিদিন, বেরোনোর রাস্তার খোঁজ না পেয়ে। মনের এই অসুখ কে সারিয়ে ফেলতে পারলে আমাদের চারিপাশ টা কি আরো সুন্দর আর রঙীন হতো না?"
-" মনের অসুখের জন্য তো মনের ডাক্তার চাই। সেটাই তো খুঁজে বেড়াচ্ছি।"
-"সেটাই তো বললাম রে গাধা। মন তো শরীরের ই অঙ্গ আর তুই তো শরীরের ডাক্তার হয়ে গেছিস। আর তো অল্প একটু রাস্তা বাকি।" - মেসোর মুখের এই হাসিটা আমার অনেক দিনের চেনা।

আমি কিছু বলতে গিয়েই বুঝতে পারলাম আমার ঠাকুর আমাকে কি করতে বলছেন। আমি তো এম.ডি করবো বলে ঠিক করেছি, কিন্তু কিসে করবো সেটা নিয়ে তো নিশ্চিত নই। মেসো কি আমাকে সাইক্রিয়াট্রি নিয়ে এম.ডি করতে বলছে? 

-"শরীরের ডাক্তার তো অনেকেই হচ্ছে, মনের ডাক্তার কতজন হচ্ছে বল? সামনের যা দিন আসছে, দেখবি মনের ডাক্তারের প্রয়োজন বেশি হবে।" - কুড়ি বছর আগের মেসোর ভবিষ্যৎবাণী এতটা সঠিক? 

অনেকদিন বাসে ওঠা হয় না। চেম্বার থেকে বেরিয়ে বাসে উঠে বসলাম। কত নম্বর সেটাও খেয়াল করি নি। শুধু কানে এসেছিল রাসবিহারী। বাস টাও বেশ ফাঁকা। জানলার ধারে একটা সিট ও পেয়ে গেলাম। আমার শহরের সব স্তরের লোক এখনো বাসে চড়ে দেখে ভালো লাগলো। রাজধানীর বাসে চড়ার অভিজ্ঞতা তো বেশ দুর্ভাগ্যজনক। এইমস-এর পরীক্ষা দেবার জন্য রাজধানীতে। গুরগাঁও তে পরিচিত এক বন্ধুর বাড়িতে যাব বলে বাসে উঠেছি। কন্ডাক্টরের চার অক্ষরের ভাই-বোনের সম্ভাষণ দেখেই বুঝতে পেরেছিলাম আমি অন্য গ্রহ তে। পাশে বসা কৌতূহলী যুবক আমার তত্ত্বতালাশে ব্যস্ত। ডাক্তার বলে পরিচয় দেওয়ায় যে ভাবে সে হেসেছিল তার থেকে বড় অপমানিত বোধহয় কোনোদিন হই নি। হাসি থামিয়ে, চার অক্ষরের সম্ভাষণ জুড়ে সে বলেছিল - কোন কাপড়ের দোকানে কাজ করি সেটা বললেও আমার চাকরি টা যাবে না কারণ সে এখন নতুন একটা ভালো দোকান পেয়েছে আর এক্ষুনি সেটা ছাড়ার তাঁর ইচ্ছা নেই।

দিল্লির পুরোনো ঘটনাটা মনে করে বেশ মজাই লাগছে এখন, যদিও সেদিন অপমানে কান লাল হয়ে গেছিল। মানুষের মনকে কাঁটা ছেড়া করতে শেখার পর আজকাল বেশ ভালোই লাগে নতুন নতুন মনের খোঁজ পেতে। খেয়াল হলো, আমার তো আজ অলি-গলিতে ঘোরার দিন। কন্ডাক্টরের হাতে রাসবিহারীর পুরো ভাড়া দিয়েও নেমে পড়লাম-বিডন স্ট্রিট। বড় রাস্তা ক্রস করে আপন খেয়ালে হেঁটে চলেছি। এদিক ওদিক ঘুরে একটা ছোট গলিতে ঢুকে পড়লাম। হরীতকী লেন। ফ্ল্যাট কালচারটা এখনো থাবা বসায় নি। লাল রকের বাড়ি গুলোর রক গুলো ফাঁকা। রকের আড্ডা গল্পের পাতাতেই এখন তাহলে শুধু পাওয়া যায়! গলির শেষ প্রান্ত থেকে মাইকের শব্দ। পল্লিবাসীকে সাদরে আমন্ত্রণ - 'সন্ধ্যের জলসার'। শহর কলকাতার ঘুমের ব্যাঘাত ঘটানো রাতভর জলসাও এখন গল্পের পাতাতে।

মেসোর পাড়ার কালীপুজোর সে বছর সুবর্ণ জয়ন্তী। প্রতিবছরই পুজোর পরের দিন মাঝরাত অব্দি জলসার আয়োজন করে পূজো কমিটি। বাবার থেকে শোনা - সত্তর দশকের দিকপালরা ওই জলসাতে একসময় রেগুলার আসতেন। নির্মলেন্দু, হেমন্ত, শ্যামল, সতীনাথ, উৎপলা, নির্মলা, প্রতিমা। সময়ের সাথে এখন শুধু বাংলা গান হলে চলবে না। ঝিল কে উসপারের 'দো ঘুট মুঝে ভি' না হলে কি আর রাতের জলসা জমতে পারে! পুজোটা আগের থেকে ছোট হয়ে এসেছে কিন্তু পাড়ার ছেলেরা এবার জলসা টা বড় করতে চায় সেলিব্রিটি দিয়ে। বম্বে থেকে শিল্পী আনার সামর্থ্য নেই, সুমন-অঞ্জন-নচিকেতা দিয়ে কোমর দোলানো সম্ভব নয়। অনেক বাক-বিতণ্ডা আর আলোচনার পর ঠিক হয়েছে - মিস্ জোজো। 

এদিকে বাড়িতে তুমুল অশান্তি কারণ ইদানিং মিঠির চলন বলন মাসীর ভালো লাগছে না। তারসাথে মিঠি দাবি করেছে সে এবার রাত জেগে জলসা দেখবে কারণ সে এখন কলেজে পড়ে, বড় হয়ে গেছে। নিজের পাড়া তে মিস্ জোজোর প্রোগ্রাম না দেখলে কলেজে মানসম্মান নিয়ে টানাটানি পরে যাবে। মেসো, মিঠির পক্ষ নেওয়াতে তৃতীয় বিশ্বযুদ্ধের দামামা বেজে গেছে। মা, মাসী আর মায়ের চাপে আমার বেচারা বাবাকেও মিত্র পক্ষে যোগদান করতে হয়েছে। কানাঘুষো তে শোনা যাচ্ছে, মিঠি কোনো এক বেকার, সকাল সন্ধ্যে পাড়ার রকে আড্ডা মারা রাজকুমারের সাথে মন দেওয়া-নেওয়াতে বিশ্বাস করে ফেলেছে। মেয়ের অন্ধকার ভবিষ্যত কল্পনা করে মা-মাসী ভীষ্মের প্রতিজ্ঞা করে ফেলেছে, নিজেদের জীবন থাকতে রাতের জলসাতে মিঠিকে যেতে দেবে না। তার উপর সেলিব্রিটি শিল্পী সব শেষে মঞ্চে উঠবে - সারারাত মেয়ে সেই ছেলের সাথে কি কি করতে পারে সেটা ভেবেই মাসি এবার মেসোর উপর ফতোয়া জারি করেছে - এসপার অথবা উসপার। দাদা হয়ে এত দিন ধরে রাখি আর ভাইফোঁটা নেবার একটা প্রতিদান তো থাকা উচিৎ! মিঠির করুণ মুখটা আর দেখা যাচ্ছে না। এবার আমি মাঠে নেমে পড়লাম। নিজের তার্কিক প্রতিভাকে কাজে লাগিয়ে মা ও মাসি কে নিরস্ত্র করলাম । শর্ত, মিঠিকে চোখে রাখার দায়িত্ব আমার। মেসোর উপর কোনো বিশ্বাস ওদের নেই। মেয়ের উপর অন্ধপ্রেম ও তারসাথে রাত বাড়ার সাথে সাথে মেসোর বিশেষ পানীয়ের প্রতি দুর্বলতা। 

বিকেল হতেই বড় রাস্তার মোড়ের মাথাতে বাঁশ ফেলে নো-এন্ট্রির সোচ্চারিত ঘোষণা। মেসোর আত্মীয় বলে আমার জন্য একটা স্বেচ্ছাসেবকের ব্যাচ ও জোগাড় হয়ে গেল। মিস্ জোজোর ফাংশন বলে কথা, মেডিকেলের কিছু বন্ধু-বান্ধবদেরও নিমন্ত্রণ করেছি। তাঁদের তত্ত্বাবধানের জন্য ব্যাচটা খুব জরুরী। পৌষানীকে আসতে বলার সাহস পাই নি। মিঠির পূর্বরাগ মায়ের রাগকে কন্ট্রোল করতে না পারলে আমার ভালোবাসার অস্তরাগ হবার সমূহ সম্ভাবনা। পাড়ার কচি কাঁচা দের আবৃত্তি, গানের পর হেমন্ত আর সন্ধ্যা কণ্ঠীতে পাড়া সুরের মূর্ছনাতে উদ্বেল। মিঠিকে, মা ও মাসির সাথে বসে থাকতে দেখে আমিও বেশ আশ্বস্ত। বাসন মাজতে মাজতে জোৎস্নার মা ও মিনুর মায়ের পরনিন্দা পরচর্চাটা একটু কম হলে বাড়িতে শুধু শুধু যুদ্ধের ঘনঘটা-টা এড়ানো যেত।

রাত এগারোটা। দর্শক আসনে মহিলার সংখ্যা বেশ কমে এসেছে। এবার কিশোর আর আশা/লতা কণ্ঠী আসরের রাশ নিজেদের হাতে তুলে নিচ্ছে। মিঠি পাড়ার চেনা কিছু সমবয়সী ও সদ্য বিবাহিতাদের সাথে বসে গান শুনছে। সদ্য বিবাহিতাদের গোপন সুখের গল্পও শুনতে পারে বলে আমার ধারণা। আমি দূর থেকে পাহারা দিচ্ছি। কোনো রকম বাচালপানা দেখলেই উদ্ধারে নেমে পড়ব। ঘন্টা খানেক হয়ে গেছে, মেসোকে দেখতে পাই নি। যদিও জানি কোথায় থাকতে পারে। জীবন কাকুর সাথে সিঙ্গল মল্ট, জীবন কাকুর বাড়িতে। জীবন কাকু, জাহাজে চাকরি করে। ছ-মাস জল, ছ-মাস ডাঙা। ডাঙাতে থাকলেই মেসো আর জীবন কাকু হরিহর আত্মা।

-"শুকনো মুখে ফাংশন কেউ দেখে নাকি?"
উজ্জ্বল, নিজের প্যান্টের দিকে আমার দৃষ্টি আকর্ষণ করছে। সাথে মেডিকেলের আরো তিনজন। 
-"পাড়া তে আমি গুড বয়। আর তারচেয়েও একটা দরকারি কাজে আমি এখান থেকে নড়তে পারবো না।" - দায়িত্ব আর নিয়ম ভাঙ্গার হাতছানির লড়াইতে কতক্ষণ নিজেকে আটকে রাখতে পারবো জানি না।

বোনের উপর আমার অগাধ আস্থা। সেই বিশ্বাসে ভর করে আধঘন্টা বাদে আমিও গলাটা ভেজাতে পাড়ার মোড়ে। পাড়ার অটো গুলো আজ গলিতে ঢুকতে পারে নি। সার বেঁধে বড় রাস্তার একদিকে দাঁড় করানো। খেয়াল করলাম, অটোগুলোই আমাদের মতন আরো অনেক ছোট ছোট গ্রুপের অস্থায়ী বার-কাউন্টার। 

'দো ঘুট মুঝে ভি' - সুরের ও সুরার তালে কোমর দুলছে আপন মনে। এর পরে মিস্ জোজো উঠবে। শিল্পীর নামের আগে ওই মিস্ শুনলেই মনে হয় আনন্দবাজারের বিজ্ঞাপনে সাইকোডলিক আলোর মধ্যে সারকারিনার মিস্ ববিতা। খুব ইচ্ছা ছিল একবার চাক্ষুষ করার। সামাজিক লজ্জার আবরণ সরিয়ে একবারের জন্য ও খারাপ হতে পারি নি। নানান ভাবনার মধ্যে খেয়াল হলো মাসির কাছে আমার দেওয়া কথা। পড়িমড়ি করে পাড়ার ভেতরে ঢুকলাম। মিঠিকে দেখতে পাচ্ছি না। মিঠির সাথে যাঁরা বসেছিল তাঁদের মধ্যে কেউ কেউ এখনো আছে। কাছে গিয়ে মিঠির ব্যাপারে জিজ্ঞাস্যা করতেও সংকোচ। অচেনা অজানা মহিলাদের কাছে মদ্যপ অবস্থায় বোনের খোঁজ নেব! সুরের উদ্দাম তালে কেউ চেয়ারে বসে নেই। এই অবস্থাতে কেমন করে খুঁজব! হটাৎ দেখি জীবন কাকু স্টেজের প্রায় সামনে, মিস্ জোজোর খুব কাছাকাছি কোমরে হাত দিয়ে জিতেন্দ্র'র নৃত্য ভঙ্গিমায়। এই বয়সে এত লোকের মধ্যে এই ভাবে কেউ নাচতে পারে সেটা আমার বিস্ময়ের বাইরে। পাশ থেকে উজ্জ্বল টিপ্পনি দিল - "পেটে পড়লেই রক্তের রং পরিষ্কার হয়ে যায়। সবার রক্তই কালচে লাল।"

গানের সুর আমার কাছে হাতুরি পেটার আওয়াজ মনে হচ্ছে। এ আমি কি করলাম! নিজের কাছে কখনো নিজেকে ক্ষমা করতে পারবো না। একে টপকে, ওর বগলের নীচ দিয়ে গলে কোনক্রমে জীবন কাকুর কাছে পৌঁছলাম। আমাকে দেখে উনি তো আরো খুশিতে ডগমগ। নাচের পার্টনার শ্রীদেবী'র অভাব পূরণ হয়েছে মনে হলো। ওই আওয়াজ আর ওনার মেজাজ ভেদ করে মেসোর খবর জানতে চাওয়া আর মৃনাল সেনকে ডিস্কো ডান্সের মতন সিনেমা বানাতে বলা এক ব্যাপার। অনেক কসরতের পর জানতে পারলাম, মেসো এখনো জীবন কাকুর বাড়ি।

কালবিলম্ব না করে ঊর্ধস্বাসে জীবন কাকুর বাড়ির দরজাতে পৌঁছলাম বেন জনসনের গতিতে। দরজাটা আধ-ভেজানো। একটু হাত লাগাতে খুলে গেল। বসার ঘরে মেসো সোফার উপর বসে আছে দরজার দিকে মুখ করে। মুখটা কি রকম একটা কাঁদো কাঁদো। আমার সব কল্পনার সীমা অতিক্রম করে মিঠি মেসোর বাঁ পাশে। মেসোর উল্টোদিকে চেয়ারে একটা ছেলে দরজার দিকে পেছন করে। এক ঝাঁক কোঁকড়া চুল। সোফার সামনের টেবিলের উপর তিনটে গ্লাস ও প্রায় শেষ হয়ে আসা সিঙ্গল মল্ট। একটা গ্লাস খালি, উল্টোনো। বাকি দুটো আধ খাওয়া।

এখানে মিঠি কি করে এলো? এই ছেলেটাই কি আমাদের ভবিষ্যতের জামাই? আমার আবার সব তালগোল পাকিয়ে যাচ্ছে। মেসোর মুখটা ওই রকম কাঁদো কাঁদো কেন?
প্রাথমিক শক টা কাটার পর, আমি যেই মুখ খুলতে যাব, মেসোর নির্দ্দেশে আমি মিঠির পাশে।

-"আলাপ করিয়ে দি, মিঠির দাদা। ডাক্তার। অনেক চেষ্টা করেছে আর এখনও করছে। ওর হাতেই আমরা সপে দিয়েছি। বাকি টা ভগবানের হাতে।"

আমি কিচ্ছু বুঝতে পারছি না। চুপ করে শুনে যাওয়া টাই বুদ্ধিমানের কাজ।

-"কবে থেকে ধরা পড়লো?"
-"বছর তিনেক হলো। শুরুর দিকে পাত্তা দেই নি। মিঠির মা'র জোরাজুরি তে ডাক্তারের কাছে গেলাম। আর তারপর।"
-"এটা কি মাঝে মাঝেই হয়?"
- "ওহ, তুমি কখনো দেখ নি। তোমার সাথে থাকার সময় হয় নি তারমানে। ভালো হয়েছে। দেখলে খুব কষ্ট পেতে। কাছের মানুষের ওই রকম হটাৎ করে পাল্টে যাওয়া, একটা বিভীষিকা। চোখ উল্টে যায়, মুখ বেঁকে গিয়ে, গাঁজলা বেরোতে থাকে। হাত পা বেঁকে যায়। "
-"না, আমি কোনো দিন দেখি নি। " - কেমন যেন একটা আর্তনাদ করে গ্লাসের বাকিটা এক চুমুকে খেয়ে নিল ছেলেটা। মেসোর মুখের কাঁদো কাঁদো ভাবটা সরে যাচ্ছে। শিকারী যেন শিকারের সন্ধান পেয়েছে। মেসোর চোখটা জ্বল জ্বল করছে কিন্তু মুখে একটা বেদনার ভাব।

-"একটা জিনিস ভেবেই আমার খারাপ লাগছে। বাকি জীবনটা তোমাকে এই দুর্ভোগটা বয়ে নিয়ে বেড়াতে হবে। যদিও আমরা পাশে থাকবো, তাও সব সময় তো তুমি হাত পেতে আমাদের থেকে সাহায্য নেবে না। তোমাকে দেখেই চিনতে পেরেছি, তোমার আত্ম-সম্মান পাহাড় প্রমাণ।" - মেসো কথাটা বলতে বলতে ছেলেটার ফাঁকা গ্লাস আবার ভর্তি করে দিল।
-"এই অসুখ কি কখনো সারে না?"
-" নাহ রে বাবা। এই যে ওর দাদা পাশে বসে আছে, ও তো ডাক্তার। ওকেই জিজ্ঞাসা করে নাও। আমাদের দুর্ভাগ্যের কথা আমার আর বলতে ভালো লাগে না।"

মেসোর সাথে থেকে থেকে আমি মোটামুটি বুঝে গেছি আমাকে কি বলতে হবে এই নাটকে। শুরু করলাম, ডাক্তারি শাস্ত্রের খটমট রোগের নাম উচ্চারণ দিয়ে, যাতে কোনোভাবেই আমাকে কেউ ডাক্তার ছাড়া অন্যকিছু ভাবতে না পারে। টানা পাঁচ-মিনিটের ভাষণে এটা বুঝিয়ে দিলাম এই রোগ সারবার নয়। তার থেকেও বড় ব্যাপার প্রতিমাসে ওষুধের পেছনে কম করে হাজার যাবে। সময় সময় হসপিটালে থাকার খরচও আলাদা। আমার ভাষণের মধ্যে দেখলাম বাবাজীবন ভর্তি গ্লাস তিন চুমুকে শেষ করে , চোখ ছানাবড়া করে আমার দিকে চেয়ে আছে। আমার পেটের ভেতর থেকে এক দলা হাসি ঠেলে বেরিয়ে আসতে চাইছে কিন্তু আমি রামগরুরের ছানার মতন যতটা সম্ভব গম্ভীর হয়ে থাকার চেষ্টা করছি। মেসোর অত্যাচার আমি আর নিতে পারছি না। বাথরুম যাবার ভান করে উঠে পড়লাম, মিঠি কে নিয়ে। সবার ক্ষমতা মেসোর মতন নয়।

ভিতরের ঘরে মিঠিকে জেরা করতেই বুঝতে পারলাম আজ মেসো তাঁর জামাইকে পরখ করবে বলে ঠিক ই করে রেখেছিল। সন্ধেবেলাতে ই মিঠিকে ডেকে বাবাজীবন কে চিনিয়ে নিয়েছিল। তারপর রাতে যখন সবাই যে যার নিজের মতন করে ব্যস্ত, তখন পাক্কা শিকারির মতন শিকার কে জীবন কাকুর বাড়ি নিয়ে আসে। মিঠিকে ও নিয়ে আসে। মিঠি কে কথা দিয়েছে , বাবাজীবন সব শোনার পর যদি মিঠিকে নিয়ে ঘর বাঁধতে চায় তাহলে নিজে হাতে মেয়ের বিয়ে দেবে বাবাজীবনের সাথে। শুধু তার আগে একটু পরখ করতে চায় মেয়ের প্রতি ভালোবাসার গভীরতা। 

নাটকের ভূমিকা শুনে, শেষটা দেখার জন্য বসার ঘরে এসে দেখি মেসো একা। বাবজীবন মেসো কে বলে গেছে বোনের এখন ভাল চিকিৎসার দরকার। কোনো কিছুর দরকার হলে সব সাহায্যের জন্য সে প্রস্তুত, কিন্তু বিয়েটা এখন করা মুশকিল। সে বেকার ছেলে, বাড়িতে বৃদ্ধ বাবা-মা। তার মধ্যে আবার এক অসুস্থ মানুষকে দায়িত্ব একটু বেশিই ভারী হয়ে যাবে। মিঠির মুখটা শুকনো। চোখটা ছলছল।

মিস্ জোজোর প্রোগ্রাম হিট। দু-চারটে মুখ ফাটানো বা কোনো পুরোনো শত্রুতার বদলা নেবার পারফেক্ট একশন, ফাংশন শেষের পরিচিত ছবি। পূজো কমিটির একে অন্যকে সাধুবাদ দিচ্ছে কোনো রকম গন্ডগোল ছাড়া ফাংশন শেষ হওয়াতে। ফাঁকা দর্শক আসনে মিঠি ওর বাবা'র কাঁধে মাথা রেখে নিস্পল দৃষ্টিতে স্টেজের দিকে তাকিয়ে। আমি দুর থেকে মিঠি'র আর মেসো'র দুজনের কষ্টই বোঝার চেষ্টা করছি। 

কতক্ষণ ধরে হরীতকী লেনের অনুষ্ঠান শুনছি খেয়াল নেই। পৌষানীর ফোনে টাইম মেশিনে বর্তমানে ফিরে এলাম। সন্ধ্যের বুলেটিন - আজ ফিরতে পারছে না। ছেলে শালার মেয়ের সাথে খেলাতে ব্যস্ত, কেউ কাউকে ছাড়তে চাইছে না। ভাইবোনের ভালোবাসা অমলিন, যতই সময় আর সমাজ পাল্টাক। একটা চেয়ার টেনে বসলাম। পুরো ফাংশন দেখে বাড়ি ফিরব। আজ তো ফেরার তাড়া নেই। ফাংশনের শেষে বাবার কাঁধে মাথা রাখা সদ্য যুবতী কাউকে কি আর দেখতে পাব!

Comments


©2020 by Hizibizi Online

bottom of page