প্রতিবিম্ব # ৩
- Abhijit Chakraborty

- Mar 31, 2020
- 5 min read
Updated: Apr 6, 2020

#প্রতিবিম্ব
(৩)
চেম্বার শেষ করে বেরিয়েছি। আজকে গাড়ি নেই, ম্যাডাম ছেলেকে নিয়ে ছেলের বন্ধুর জন্মদিনে গেছেন। এখন অবশ্য উবের-ওলার দৌলতে ফেরার ব্যাপারটা নিয়ে চিন্তা থাকে না, সে যত রাত ই হোক না কেন। ইদানিং যদিও কুবেরের ধন উবেরের হাতেই শেষ হবার বেশ সম্ভাবনা দেখা দিচ্ছে। রাত হলেই সারথি দের ফোনও আসে - কোথায় যাবেন? উত্তর থেকে দক্ষিণে আসার কথা শুনিয়ে পরপর দুবার প্রত্যাখ্যাত হলাম। এখন আবার দক্ষিণ শুনলে দ্বিতীয় প্রশ্ন আসে - বেহালার দিকে কি?
হলুদ ট্যাক্সি ও আজকাল আর দেখা দেয় না। ভাবতে অবাক লাগে, নিজের চোখের সামনে কতকিছুরই বিলুপ্তির সাক্ষী হয়ে থাকলাম। লাল রংয়ের দোতলা বাস থেকে হলুদ ট্যাক্সি।
ভয় হয় প্রাণের প্রিয় ক্লাবটা না আবার হারিয়ে যায় সময়ের গর্ভে।
ক্রেতার মনকে চেনার পারদর্শিতার মধ্যেই ব্যবসায় সাফল্যের চাবিকাঠি লুকিয়ে থাকে। আমাকে তুষ্ট করতে এবার প্রিমিয়ার সেগমেন্টের গাড়ি পাঠানোর ব্যবস্থা করে দিয়েছে বহুজাতিক সংস্থা। গাড়ির চালকের উপর বিশ্বাসের গ্রাফটা এখন নীচের দিকে। সামনে একটা হলুদ ট্যাক্সি। প্রত্যাখ্যাত হবো জেনেও এগোলাম।
খোলা জানলা দিয়ে শরতের রাতের পুজোর গন্ধ মাখা হাওয়া - সারাদিনের ক্লান্তি কে পরম মমতায় সরিয়ে দিচ্ছে। ট্যাক্সিওয়ালা কে জিজ্ঞাসা করতে ইচ্ছে করছে -
"আচ্ছা তুমি তো সারা দিন ট্যাক্সি চালাচ্ছ। কত বিভিন্ন স্বাদের, বর্ণের, গন্ধের মানুষ কে তুমি দেখছ, শুনছ। যে অচেনা লোকটা তোমার গাড়িতে, তাঁর সম্বন্ধে জানতে ইচ্ছা করে না? হয়তো যাত্রী ফোনে কারুর সাথে কোন মশলাদার কথা বলছে তখন যাত্রীর মন জানতে ইচ্ছা করে না? বা ওই মশলা থেকে আর একটু ঘটনার ভিতরে ঢোকার কৌতুহল অনুভব করো?" - নাহ এই সব জিজ্ঞাসা করলে বৌয়ের এর মতন এই ড্রাইভার মহাশয় ও আমাকে নেশাগ্রস্ত ভাববে। বাস্তব দৈনন্দিন ঘটনার দিকেই ফিরে আসা ভাল।
সেন্ট্রাল এভিনিউতে এই রাতেও বেশ ভীড়। শোভাবাজার আর গিরিশ পার্কের মাঝে পরপর অনেক গুলো ট্রলার আর লরি দাঁড়িয়ে আছে। মা চলেছেন বাপের বাড়ি ছেলেমেয়ে নিয়ে।
সিনেমার মতন আমার ভাবনায় ফ্ল্যাশব্যাক।
হায়ার সেকেন্ডারি র সাথে জয়েন্ট এন্ট্রাস দেওয়াটা বাধ্যতামূলক। মায়ের স্বপ্ন ছেলে 'আমার' ডাক্তার হবে। আশপাশের জ্ঞাতি গুষ্ঠিতে দূরবীন দিয়ে খুঁজলেও কোন ডাক্তার-ইঞ্জিনিয়ার নেই। বাবা-মায়ের সন্মান আর বুড়ো বয়সে বাবা-মা কে সুস্থ রাখতে পারার ইনসেন্টিভ। এর সাথে আবার বাণী বসুর 'উত্তরসাধক' পুজোর বোনাস - চোখের তলাতে কালি ফেলে আমি কলকাতা মেডিকেলে। ফুটবলার হতে চাওয়ার ইচ্ছের সলিল সমাধি। আমার এ হেন মতের পরিবর্তন মেসোকে সত্যি খুশি করেছিল কি না, জানার চেষ্ঠাও করি নি।
মায়ের ইচ্ছেপূরণ হচ্ছে। তাই অনেক কিছুতেই এখন ছাড় পাওয়া যাচ্ছে। পাড়ার ঠাকুর আনতে যাওয়ার জন্য পারমিশন পেতেও খুব একটা কাঠখড় পোড়াতে হলো না। বাবাকে আমি কখনো পাড়ার ঠাকুর আনতে দেখি নি। তবে হ্যাঁ, লরি থেকে মণ্ডপে ঠাকুর ওঠানোর সময় আর বিসর্জনের দিন ঠাকুরের কাঠমা ধরে হাঁটু অব্দি জলে নামতে বাবাকে দেখেছি। বিসর্জনের গল্প না হয় আরেক দিন। পাড়ার কাকিমা-জেঠিমাদের সাথে মাকেও দেখতাম শাঁখ বাজিয়ে আর উলু দিয়ে ঠাকুরকে মণ্ডপে তুলতে। সে যত রাত ই হোক।
আমাদের পাড়া তে না থাকলেও, মেসো ছাড়া আমাদের পুজো অসম্পূর্ণ। ঠাকুর আনতে যাওয়া থেকে বিসর্জন। শুধু, আমাদের পাড়া নয়। মেসোর নিজের পাড়া আর তারসাথে দু-একটা খেপ খেলা পাড়াও আছে। এত এনার্জি কোথা থেকে পেত কে জানে! প্রশান্ত দার ছাড়পত্র ছাড়া ঠাকুরের এদিক-ওদিক যাওয়ার জো নেই।
আমাদের ঠাকুর প্রত্যেক বছর কুমারটুলী থেকে আসে। পরের দিন রবিবার তাই একটু দেরি করেই এবার ঠাকুর আনতে যাওয়া। মেসো নিজে থেকে অভয়বানী দিয়েছে মাকে - "রন্টু এখন বড় হয়ে গেছে"।
"এই গলি দিয়ে এই এত বড় বড় ঠাকুর বেরোবে কি করে! " - কুমারটুলীর সাথে আমার প্রথম পরিচয়।
"শুধু মন দিয়ে দেখে যা। পড়াশোনার বিদ্যের বাইরেও অভিজ্ঞতা আর সত্যিকারের ইঞ্জিনিয়ারিং-এর মিশেল।
প্রত্যন্ত গ্রাম থেকে আসা কিছু মানুষ যারা মূলত চাষ করে, তারাই পুজোর সময় বউ-বাচ্চাদের মুখে হাসি ফোটানোর তাগিদে কুলিরও কাজ করে। ছোট ছোট দলের আবার একজন করে সর্দার থাকে। বেশ কিছু সর্দার মেসো কেও চেনে দেখলাম। মেসোর পাড়ার ঠাকুর তোলাটাও ওদের কাছে একটা সম্মানের ব্যাপার।
আমাদের ঠাকুরের গায়ে রঙের শেষ পোঁচ টা ঘন্টা দু-এক আগে পড়েছে। মেসোর বিধান, আরো ঘন্টা খানেক বাদে যেন ঠাকুর তোলা হয়। আর আমাকে নির্দেশ পাল বংশের রথী-মহারথীদের ডেরা গুলো ঘুরে দেখা। শিল্প সৃষ্টির মাহেন্দ্রক্ষণ কে চেটেপুটে নেবার সুযোগ সবসময় আসে না। আমি আর নতুন করে পরিচয় হওয়া কিছু পাড়াতুতো দাদা মেসোর নির্দ্দেশ অক্ষরে অক্ষরে পালন করছি। হঠাৎ করে নিজেকে আবিষ্কার করলাম আমি কুমারটুলীর ভুলভুলাইতে আটকে গেছি। এখন আমি আর ক্লাস সেভেনে পড়া বাচ্চা ছেলে নয় যে হারিয়ে যাবার ভয়ে ভ্যা করে কেঁদে ফেলব।
আরো আধঘন্টার চেষ্ঠা তে আমাদের গোলা খুঁজে পেলাম, মেসোর গলা আর হৈ-হট্টগোলে। জটলার সামনে গিয়ে দেখি - মেসোর দাবি, সবার আগে গণেশ লরিতে উঠবে আর পাড়াতে গিয়েও গনেশকেই প্রথমে নামাতে হবে। সবাই প্রচুর করে বোঝানোর চেষ্ঠায় ব্যর্থ। আমাকে দেখে বেশ কিছু প্রবীণ ও নবীন প্রায় ছুটে আসছে। আমাকেই নাকি মেসোকে বোঝাতে হবে। আমার মাথাতে বজ্রপাত। মেসোর কাছাকাছি যেতেই চেনা গন্ধ। ফরমালিনের সাথে এই গন্ধটার সাথে ও পরিচয় বাড়ছে।
-"আরে মেসো, কি বলছ কি? সবাই কি ভাবছে?"
-"আমি তো কোন অন্যায় আবদার করছি না। আমি একটা প্রব্লেম স্টেটমেন্ট দিয়েছি, সেটা যে কুলির দল সলিউশন দিতে পারবে, আমি সেই কুলিদের ই নিয়ে যাব" - আবার সেই দুস্টুমির চোখ।
-"এটার কি কোন সলিউশন আছে বলো?তুমিও তো জানো যে এটা কখনো সম্ভব নয়। ফালতু সিন ক্রিয়েট হচ্ছে" - ওই চোখের উত্তরে রাগ প্রকাশও অসম্ভব।
-"তোরা ও তো আছিস। শুধু কুলিদের দোষ দিচ্ছিস কেন? তোরা ভেবে একটা লজিক্যাল সলিউশন দে। কেউ মাথা খাটাবে না, শুধু যত দোষ প্রশান্ত ঘোষ, স্যরি, সিনহা।"
-"মেসো এবার কিন্তু ব্যাপারটা আর মজার থাকছে না। - মুখটা আমাকে গম্ভীর করতেই হতো। আমি হাতটা ধরে মেসোকে ভিড় থেকে একটু দূরে সরে আনলাম।
-"ভালোই করেছিস। সবার সামনে বুদ্ধির বহরের পরীক্ষা দিতে না বসে। লোক হাসানোর থেকে নিজেকে বাঁচিয়ে নিলি। ভেরি গুড। আমি ইম্প্রেসড।"
আমি কি বলব ভেবে পাচ্ছি না। মেসোর উপর রাগটা আর চেপে রাখতে পারছি না।
"আরে বোকা , রেগে গেলে তো আর লজিক্যাল সলিউশন দিতে পারবি না। মাইন্ড তো পুরো ব্লক।" - চোখটা পিটপিট করছে মেসোর , একটা অদ্ভুত খুশি তে।
-"ওকে। আমরা সবাই তোমার বুদ্ধির কাছে পরাজিত। তুমিই নিজে সলিউশন দাও। আমরা মুখ বুজে মেনে নেব যা বলবে।"
-"ছেলে তো একদম তৈরি। নিজের বুদ্ধির অক্ষমতা মেনে নিয়ে সেন্টু দিয়ে ম্যাচ বার করার চেষ্ঠা। ব্রাভো।"
কি করে বোঝাই যে আমার বুদ্ধির দৌড় খুবই সীমিত। জাস্ট গাঁতিয়েও নম্বর তোলাও যায়।
-"নাহ, তোকে আমি খুব বুদ্ধিমান হিসাবে ভাবি না। আর ভাবার জন্য এখনো কোনো প্রমাণ পাই নি। তাই ভাবছিলাম যদি জয়েন্ট এন্টার্সের মতন একটা ছোট টেস্ট নিয়ে নি।"
-"আমি ডাহা ফেল। তুমি উত্তর বাতলে দাও, প্লিজ।" - মেসো যতই খোঁচাক, আমি আমার উইকেট দেব না।
-"আমি এমনিতেই সলিউশন টা বলেও দেব। একটু ব্যবসার বুদ্ধি খরচ করতে হতো। একটা জিনিস নিয়ে আমার ধন্দ টা খানিকটা দূর হলো। কমার্স নিয়ে না পড়ে ঠিকই আছে।"
আমি শ্রোতা।
-"কুলিগুলো বলতেই পারতো যে ঠিক আছে, আপনারা আর একটা লরি ভাড়া করুন, এখানে তো লরি থাকেই।" - মেসোর মুখের খুশি চলকে চলকে পড়ছে।
-"পয়সাটা কে দিত?"
-"আমি তো তোদের থেকে যে কোনো লজিক্যাল সলিউশন চেয়েছিলাম। পয়সাটা আমিই দিতাম। যাই হোক, এখন এটাকে বলে তোমাকে বাহবা পেতে হবে না। মায়ের মতন ছেলের পুজোটা আর একটু বাড়লে কুলিগুলো বোধহয় আর কুলি হয়ে থাকতো না।"
আমি ভাবছি, ইশ এটা তো আমি ও ভাবতে পারতাম। নিজেকে সত্যি সত্যিই গাধা লাগছে।
-"যা, প্রথমে গণেশ তুলতে বল। শেষ টা ছেড়ে দিলাম। পাড়ায় গিয়ে তোর কিন্তু জয়গান হবে। তোর মা-বাবা ও ভরসা পাবে যে তুই বড় হয়েগেছিস। তোর বোঝানোতেই তো আমি বুঝলাম! কি বুঝলি?" - গোলা থেকে আসা ঝাপসা হলুদ আলোতে মেসোর চোখের খুশি টা একদম নির্ভেজাল।
সেদিনের বিড়ম্বনা শুধু এখানেই শেষ নয়। এর পরের ঘটনাটা ভাবলে এখনো আঁতকে উঠি।
মোবাইলের স্ক্রিনে বউয়ের নামটা দেখে আঁতকে উঠলাম।
-"হ্যাঁ, বেরিয়েছি। পেশেন্ট ছিল বেশি। রাস্তায় একটু জ্যাম আছে।"
ভালো লাগছে না কথা বাড়াতে। লরি নিয়ে ফেরার সময়ের ঘটনা তে ডুব দিলাম।



Comments