প্রতিবিম্ব # ২
- Abhijit Chakraborty

- Mar 26, 2020
- 5 min read
Updated: Apr 6, 2020

মাঝামাঝি কথা রেখেছি। আজকের পার্টিতে বাড়াবাড়ি কিছু করি নি, শুধু তিন-চার পেগ পুলিশ মার্কিং এড়িয়ে সাটিয়ে দিয়েছি। দায়িত্ববান বাবা ও স্বামী বলে কথা! মদ খেয়ে মাতলামি - ছিঃ! আমি তো আর রোজ রোজ সন্ধ্যে বেলায় বাড়িতে আসর বসাই না। সামনে কেউ খেলে শুধু নিজেকে আটকাতে পারি না। বাকি অনেক কিছুতেই কিন্তু আমি নিজেকে আটকে রেখেছি। এই যেমন, এখনো সুসজ্জিত গেটেড কমপ্লেক্সের হাতছানি এড়িয়ে নিজের বাড়ির ছাদে নিজের সাথে নিজের কথা বলাকে আটকে রেখেছি।
মা ও ছেলে অকাতরে ঘুমোচ্ছে। আমি , আমার প্রিয় ছাদে। যেদিন পেটে দু-চার পাত্তর পরে সেদিন তো আবার বেশি বেশি করে ছাদ টা ভালো লাগে! জীবনের অনেক ঘটনা ও তাঁর অনুভবের সাক্ষী এই ছাদ। 'পেট কাটি চাদিয়াল' থেকে 'ইয়ে লাল রং কব মুঝে ছোড়েগা'। ছাদের কার্নিশ ঘেষে দাঁড়িয়ে থাকা নারকেল গাছ আমার সব জানে।
যাই হোক, এবারে ফিরি মেসোর কথায়। আমুদে এক মানুষ যাকে নিয়ে সবার মনে দ্বন্দ। প্রাণখোলা আবেগ কে বয়ে নিয়ে চলা মনের ভিতরে সযত্নে লুকিয়ে রাখা বেদনার লুকোচুরি। আমি মাধ্যমিকে বেশ বড়াই করার মতন রেজাল্ট করে তখন সবার চোখের মণি। সন্ধ্যে বেলায় মেসোর আগমন, সাথে মাসিমণি আর মিঠি। মেসো কে দেখেই মায়ের চোখ মুখে অশনি সংকেত এই খুশির দিনেও। রান্না ঘরে আড়ি পাততে শুনতে পেলাম মা-বাবার কথোপকথন।
- "প্রশান্ত দা আজ নিশ্চয়ই এখানে আবার বোতল খুলে বসবে না।"
-" না না, চিন্তা করো না । এত অচেনা মানুষের মধ্যে প্রশান্ত ওই রকম বেহিসেবি কাজ করতে যাবে কেন! তুমি ভীষণ আজে বাজে চিন্তা করো।"
বাবার অভয়বানী ও মাকে ঠিক নিশ্চয়তা দিলো না, এটা মায়ের চোখ মুখ দেখে বুঝতে পারলাম। সন্ধ্যে টা বেশ নির্ভীগ্নে কাটছে দেখে আমারও বেশ ভালো লাগছে। বছর তিনেক আগের নিউ মার্কেটের অভিজ্ঞতার পর মেসো সম্বন্ধে আমিও একটু সন্দিহান থাকি।
ডাক্তার না ইঞ্জিনিয়ার হবো সেটা বোধহয় আজই ঠিক হয়ে যাবে। রেজাল্ট বেরোনোর আনন্দের থেকেও অনিশ্চিত ভবিষ্যৎ সুরক্ষিত করার রক্ষাকবচ নিয়ে নানা মুনির নানা মত। আমার বেশ এবার বিরক্ত লাগতে শুরু করেছে।
-"ছাদে যাবি?" - কাধে একটা আলতো টোকা।
আমি আর মেসো সবার অলক্ষ্যে ছাদে উঠে এলাম। যার উপলক্ষে সবার আসা, সে কোথায় গেল তা নিয়ে কারুর মাথাব্যাথা নেই, তার ভবিষ্যত নিয়ে সবার চিন্তা - বেশ মজার লাগল ব্যাপারটা।চাঁদের আলোতে আজ ছাদ টা ঝলমল করছে। আমরা দুজনে নারকেল গাছটার কাছে গিয়ে দাঁড়ালাম। পাঁচিলের গায়ে হেলান দিয়ে সিগারেটের ধোঁয়া উড়িয়ে মেসোর সাথে আমার প্রথম সাবালক পরিচয়।
-"সবাই তো তোকে ডাক্তার বা ইঞ্জিনিয়ার করে তুলবে দেখছি। তুই কি হতে চাস?" - আমার ইচ্ছেটা এত বড় তোমার কাছে? জিজ্ঞাসা করতে ইচ্ছা করলো। হাসি মুখে বললাম - " তোমার মতন আমি ফুটবলার হতে চাই। ইন্ডিয়া খেলতে চাই"।
অতর্কিতে বাজ পড়লো মনে হলো আমার কথাতে। মেসোর মুখটা কেমন যেন পাংশুটে লাগছে। আমি তো ভাবলাম, মেসো খুবই খুশি হবে আমার ইচ্ছের কথা শুনে।
-"জানিস রন্টু, তুই যদি ফুটবলার হোস তাহলে আমার চেয়ে বেশি আনন্দ কেউ পাবে না। কিন্তু সেই আমি বলছি, যত তাড়াতাড়ি পারিস স্বপ্ন টা ভুলে যা।"
মেসোর উপর খুব অভিমান হতে লাগল। একটা কিশোরের স্বপ্ন কে এইভাবে আঘাত করা টা কি খুব জরুরি ছিল। তাও, আজকের দিনে? এত নিষ্ঠুর হতে পারে মানুষ? আমার আর এক মুহূর্ত মেসোর সাথে থাকতে ইচ্ছা করছে না। নিজে বড় ক্লাবে সই করেছিল কিন্তু একটা ম্যাচেও সুযোগ পায় নি। নিজের ব্যর্থতা ঢাকতে আমার স্বপ্নকে জলাঞ্জলি দিতে হবে কেন?
-"জানি তুই আমার উপর রাগ করছিস। আর একটু বড় হলে হয়ত বুঝতে পারবি" - মেসোর হাত আমার কাঁধে। ইচ্ছা করছে এক হ্যাঁচকা তে হাত টা সরিয়ে দি।
-"আমিও তোর মতন একরাশ স্বপ্ন নিয়ে ময়দানের ঘাসে পা রেখে ছিলাম। বড় ক্লাব খেলব, ইন্ডিয়া খেলব, এশিয়াড খেলব। খিদিরপুর হয়ে এরিয়ানে যেদিন সই করলাম, মনে হল, স্বপ্ন টা প্রায় ছুঁয়ে ফেলেছি।" - মেসোর চোখটা রাতের অন্ধকারেও কি রকম জ্বলজ্বল করছে। আমিও অভিমান ভুলে মেসোর অতীতে।
-"তিন-বছর এরিয়ানে খেলা হয়ে গেছে। শেষ বছর তিন বড় দলকেই আটকে দিয়েছি। কাগজে প্রশান্ত সিনহার নামের কাটিং রেখে দিয়েছি সযত্নে। দল বদলের সময় আমাকে নিয়ে দুই প্রধানের সে কি টানাটানি। আমি মনস্থির করতে পারছি না, কোন ক্লাবে সই করব। সই করার আগের রাতে, একদল ছেলে এসে আমাকে তুলে নিয়ে গেল গোপন ডেরাতে অন্যপক্ষ কে টেক্কা দিয়ে।" - সেদিনের উত্তেজনা এখনো প্ৰকাশ পাচ্ছে মেসোর চোখেমুখে।
-"লিগের বেশ কয়েকটা ম্যাচ হয়ে গেছে, আমি ফার্স্ট ইলেভেনে নেই। টিম তার মধ্যে দুটো ড্র করেছে আর দুটো বাজে গোলও খেয়েছে। ক্লাবের মেসে থাকতাম। আমার রুমমেট ছিল আর এক উঠতি প্লেয়ার, অসীম দত্ত। স্ট্রাইকার। উয়াড়ি স্পোর্টিং থেকে সাইন করেছে। গোলটা ভালো চেনে। একটু মাথা গরম করে এই যা। আমরা দুজনে ময়দান থেকে হেঁটে পার্ক স্ট্রিটের কাছে মেসে ফিরতাম। বড় ক্লাবে খেলার স্বপ্ন টা কেমন যেন আরো দূরে সরে যাচ্ছে। রাত জাগা শরীর আর ভাঙা মন সকালের প্র্যাকটিসেও আর আগের মতন এনার্জি সাপ্লাই করতে পারছে না। দুজনের মধ্যেই একটা ডিপ্রেশন আসছে এটা বুঝতে পেরে, নিজের মনকে আরো শক্ত করতাম-মনে মনে বলতাম-শুধু একটা চান্স।"
-তুমি তোমাদের কোচকে বলেছিলে এই একটা সুযোগ দেবার ব্যাপার?
-"নিজের কাছে মাথা নামিয়ে কথাটা বলতে পারলে বোধহয় এখন সারাক্ষণ নিজের কাছে মাথা উঁচু করে বাঁচতে পারতাম।" - মেসোর চোয়াল শক্ত হতে এর আগে আমি দেখি নি।
-"ঠিক বুঝলাম না ।" - কৈশোর পেরোনো কৌতুহল মনের প্রশ্ন করতে কোনো বাধো বাধো ভাব থাকে না বোধহয়।
-"মন না ভিজলে যে মনের ভাব বেরোবে না রন্টু সোনা" - দুস্টুমি ভরা চোখে কি রকম একটা আনন্দের ঝিলিক। মুখের এই রকম ইন্সট্যান্ট ভাবের পরিবর্তন শোলের আসরানী কেও বলে বলে তিন গোল দেবে।
-"মানে?"
-"এক বোতল জল আর একটা গ্লাস সামনে এলেই মনের ভাব টা এসে যাবে। তুই নিচের থেকে চট করে একটা জলের বোতল নিয়ে চলে আয়। দেখিস তোর মাসিমণি আর মা যেন আবার দেখতে না পারে। "
ধর্মসংকট। জীবনে প্রথম বার। খেলার মাঠের গল্পের দূর্নিবার আকর্ষণ আর তাঁর সাথে বাবার পরাজয়। মেসোর অমায়িক মুখের পেছনে লুকিয়ে থাকা যন্ত্রণার কাছে বাবার হেরে যাওয়া টা তুচ্ছ মনে হোলো। নিপুনতার সাথে মা-মাসীর চোখ এড়িয়ে জলের বোতল নিয়ে আমি হাজির ছাদে।
নিমেষের মধ্যে মেসো ঢকঢক করে আর্ধেক বোতল জল শেষ করে ফেলল । খালি গ্লাস আমার হাতে ধরা। বোতল থেকে ওই গ্লাসে জল ঢালতে শুরু করেছে মেসো। আমার অবস্থা কিংকর্ত্যব্যবিমূঢ় । মনের ভাব বোঝানোর জন্য বাংলাতে ভালো নম্বর পেলেই তো হয়, তাঁর জন্য মনকে কি ভাবে ভিজতে হয় কে জানে! আমার চোখ অন্য কোনো বোতল খুঁজছে।
-"রন্টু, এখানে কি করছিস, সবাই তোকে কখন থেকে খুঁজছে ? - পিছন থেকে মায়ের গলা। আমার হাত থেকে কি রকম ফস করে গ্লাসটা পড়ে ভেঙে গেল।
-"তোরা এখানে কি করছিস? ছি ছি, প্রশান্ত দা। একটু তো মানসম্মান রাখো। শেষ পর্য্যন্ত রন্টুকে তুমি" - মা উত্তেজনায় কাঁপছে। আলো ঝলমল ছাদে এখন অমাবস্যার ঘোর ছায়া।
-"ছোড়দি, শুধু জল খেলেও কি আজকাল মানসম্মান চলে যাচ্ছে? " - দিলদরিয়া দরাজ মেসোর বোতল ধরা হাত উপরে তোলা। আর্ধেক ভর্তি জলের বোতলের জলের মৃদু কম্পনের মতন মেসোর মুখে হাসি।
মায়ের আকস্মিক ছাদে উঠে আসা আমাকে আরো দু-বছর পিছিয়ে দিয়েছিল মেসোর ময়দানের বঞ্চনার ইতিহাস জানতে। বড় দলের মেসে কাটানো হতাশার রাত গুলো কি ভাবে ঠেলে দিয়েছিল মদের নেশাতে। এরিয়ানে খেলতে খেলতে পাওয়া ব্যাংকের চাকরি করা আর ব্যাংক ফুটবলে সুনাম পেয়েই নিজের স্বপ্নের সাথে আপোষ করে নেওয়াই ছিল ভবিতব্য!
-"কালকে কি তোমার ছুটি? " - পেছন থেকে বউয়ের ডাক। মেসোর আপোষ করা ভবিতব্যের কাহিনীর বলাও পিছিয়ে গেল।
-




Comments