একুশের প্রতিশ্রুতি
- Abhijit Chakraborty

- Feb 14, 2021
- 6 min read
Updated: Sep 11, 2021

সন্ধ্যে হলেই একটা বসন্তের হাওয়া দিচ্ছে কয়েকদিন হলো। শীত টা কেমন জাঁকিয়ে পড়ার আগেই , কোথায় পালিয়ে গেল। অবশ্য, বাংলা ক্যালেন্ডার মতন তো বসন্তের এখনই আসার কথা। এই হচ্ছে মুশকিল ! দুই ভাষার অনুভব প্রকাশের শৈলীর মতনই আলাদা। ফেব্রুয়ারি কে উইন্টার বলেই কেন ভাবতে ভালো লাগে, বুঝে পাই না। শীতের পিকনিকের আমেজটা লেগে থাকে বলে নাকি সরস্বতী পুজোর সকালে স্নান করার ঠকঠকানি টা ভুলতে পারি না!
বাঙালি নাকি রোমান্টিক জাত ! এই বসন্ত এলেই বাঙালির সব মনের জানলা নাকি খুলে যায়। কবি, লেখক দের কল্পনার হাত ধরে রোমান্সের সাগরে মাঝে মাঝেই নৌকো নিয়ে হাওয়া খেতে বেরিয়ে পরে। যদিও বেশির ভাগ নৌকাই মাঝ সাগরের ঘূর্ণি ঝড়ে দিক খুঁজে না পেয়ে সলিল সমাধি ঘটায়। সেই যখন ঝড় সামলাতে পারবি না, কেন রে বাপু ওই সব অ্যাডভেঞ্চার করার শখ! যে জাত, হাঁটু গেড়ে হাতে ফুল নিয়ে চিবুক উঁচু করে সাহসী পুরুষের মতন প্রপোজ না করে বারোশো তেত্রিশ রকম ইঙ্গিত দিয়ে মনের ভালোবাসা ব্যক্ত করে সেই জাতের আর যাই হোক ভালোবাসা হলো না। তাই ওই গল্প - কবিতাই ভরসা।
এই ভালোবাসার কথা হলেই অফিসের পিকলু দার কথা মনে পড়ে। পিকলু দার প্রায় একুশ বছরের বিবাহিত জীবন। বেসরকারি সংস্থার হিসাবরক্ষক হিসাবে পাওয়া ওই স্বল্প মাইনের সংসারে কি করে যে এখনও ভালোবাসা পাখা মেলে ঘুরে বেড়ায় সেটা ভেবে কুল কিনারা পাই না। অথচ ঝাঁ চকচকে গাড়ি করে ঘুরে বেড়ানো, পাঁচ তারা হোটেলে উইকএন্ড ডিনার করা দাম্পত্যে বেদনার সুর। কথায় কথায় ডিপ্রেসন। একাকীত্ব বোধ। সবার সাথে একসাথে থাকতে গেলে তো অনেক কিছু স্যাক্রিফাইস করতে হয় - সেটা না করে নিজের জীবন, একটাই জীবন, এই সব ভাবনা প্রশ্রয় দিয়ে এক জীবনে সব মোক্ষ লাভের পিছনে ছুটবে আর কাদুনি গাইবে যে কেউ আমাকে বুঝলো না, সবাই আমাকে ফেলে চলে গেল। একা থাকার আনন্দও নেবে আবার আমার কেউ নেই বলে হা হুতাশ করবে আর তারপর ডাক্তারের কাছে গিয়ে জীবনের মানে খোঁজার চেষ্টা করবে। পিকলু দার উপর খুব রাগ হয় এক এক সময়। নিজের ভালো থাকার গুপ্ত রহস্য তো এদের সাথে একটু ভাগ করে নিতে পারে, মানুষ গুলো তাহলে একটু খুশি থাকতে পারতো। ছোটবেলা তে শিখেছিলাম দুঃখ ভাগ করলে কমে আর আনন্দ ভাগ করলে বাড়ে। ছোটবেলার শেখা গুলো কেমন যেন উল্টেপাল্টে যাচ্ছে। দুঃখ ভাগ করতে এখন লজ্জা আর আনন্দ ভাগ করলে কমে যাবার ভয়।
আজ শনিবার। কাল আবার তো ভ্যালেন্টাইন ডে। অফিস থেকে তাড়াতাড়ি বেরিয়ে বউয়ের জন্য কিছু একটা তো কিনতেই হবে! নয় বছর বিয়ে হয়েছে। তার আগে বছর চারেকের উথাল পাতাল করা প্রেম। একদম এক দুজে কে লিয়ের কমল হাসান আর রতি অগ্নিহত্রি । বাড়ির মত না পেলে একসাথে এই জীবন দিয়ে দেবো - জায়গাটা ফাইনাল করার জন্য টাটা সেন্টারের লিফটম্যানের সাথে বন্ধুত্বও পাতিয়ে ফেলেছিলাম। কি অদ্ভুত! বিয়ের দশ বছরের মধ্যেই কেমন যেন দমবন্ধ লাগে সম্পর্ক টা। দুজনেই বোধহয় দুজনের থেকে মুক্তি পেতে চাই অথচ ভ্যালেন্টাইন ডে সেলিব্রেট করতে হবে বলে গিফট টাও কিনতে হবে। নিজের খেয়ালেই মনে মনে হেসে উঠি - যাক বাবা, একদিনের জন্য হলেও বাঙালি তাহলে বেশ রোমান্টিক হয়ে উঠছে।
-"কি রে হনহন করে যাচ্ছিস কোথায়?" অফিস থেকে বেরোচ্ছি, পেছন থেকে পিকলু দার রিনরিনে গলা।
-"একবার সাউথ সিটি যেতে হবে। "
-"মাসের মাঝখানে সাউথ সিটি। হটাৎ বেশ সাহসী হয়ে উঠেছিস তো।"
-"তোমার আর কি! তুমি এইসব বুঝবে না। "
-"না বোঝালে কি করে বুঝবো বল?"
পিকলু দা কে কি করে বোঝাবো ভালোবাসার অভিনয়ের কথা। একুশ বছর পরেও টিফিন ক্যারিয়ারে যে বউয়ের হাতের রান্না নিয়ে আসে তাকে
ভ্যালেন্টাইন ডের জন্য দামী গিফট কেনার প্রয়োজনীয়তা বোঝানো আর যাই হোক আমার কম্ম নয়। মাঝেমাঝে অবশ্য কুঁজোও চিৎ হয়ে শোবার চেষ্টা করে।
-"আচ্ছা, পিকলু দা তুমি কোনদিন বৌদিকে ভ্যালেন্টাইন ডের জন্য গিফট দিয়েছ?"
প্রশ্নটা শুনে পিকলু দার চোখ অপার বিস্ময়ে ফেটে পড়ছে। কেমন যেন নেশার ঘোর না কাটা চোখ একদৃষ্টে আমাকেই প্রশ্ন করছে, ভ্যালেন্টাইন ডে, সেটা আবার কি? গিফট? বউ কে গিফট দিতে হয় না কি? গিফট দেবার জন্য আবার কোন বিশেষ দিন হয় না কি?
-"আমি বাপু, পুরনো দিনের লোক। তোদের মতন কথায় কথায় বউকে উপহার দিতে পারি না। "
-"বৌদিকে কে ভয় পাও না?"
- "হে হে, বিয়ে করা পুরুষ মানুষ বউকে ভয় পাবে না , সেটা হয় না কি?" - খ্যাক খ্যাক করে পিকলু দা হাসছে।
-"তারপরও তুমি বৌদিকে খুশি করার জন্য কোনো গিফট দেও না? আজ থেকে তুমি হলে আমার দেখা অন্যতম সাহসী বাঙালি।খালি হাতে বাঘের সাথে যুদ্ধ করে বা ভরা বর্ষাতে উত্তাল দামোদর সাঁতার কেটে পার হয়ে সাহসের পরিচয় এর কাছে ফিকে হয়ে যায়।"
-"ফাজলামো বন্ধ কর। চল একটু বসবি নাকি?"
-" মাথা খারাপ না কি! তোমার এই একটু বসা মানেই রাত এগারোটা, সাউথ সিটি বন্ধ হয়ে যাবে, কাল রবিবার। কোনো সিন ই নেই।"
-"আরে না না, তোর বৌদিকে বলে এসেছি আজ তাড়াতাড়ি বাড়ি ফিরব।"
-"তুমি আমাকে আজ বাজে কেস দেবে মনে হচ্ছে।"
-"তুই কি বাচ্চা ছেলে যে তোকে আমি ধরে বেঁধে রাখবো? তোর যখন ইচ্ছে তখন উঠে বেরিয়ে যাবি।"
পিকলুদা'র ডাকে কি রকম একটা অমোঘ টান থাকে। বিয়ের আগে রশ্মির ডাক টাও বোধহয় এই রকমই লাগতো। এখন অবশ্য সেই ডাক শোনার ভয়ে বাড়িতে ফিরতে, গায়ে জ্বর আসে। বরং পিকলু দার সাথে কাটানো সময় গুলো অনেক অনেক শান্তির মনে হয়, যেখানে এক পশলা বৃষ্টি মাঝে মাঝে দমবন্ধ জীবনে স্বস্তির নিঃশ্বাস নিতে দেয়, সহজ সম্পর্কে।
ছোট ঘড়ির কাঁটা আট আর নয়ের ঘরে আর আমি তিন শেষ করে চার পেগের মাঝামাঝি। কর্তব্য আর কল্পনার মধ্যে পেন্ডুলামের মতন দুলছি। কল্পনার পাখা মেলে নিজেকে ভুলিয়ে রেখেছি বাস্তবের পাওয়া-না-পাওয়ার দ্বন্দ্ব থেকে। পিকলু দা কে দেখে মনে হয় জীবন টা কত সুন্দর, সহজ, সাবলীল। সুরাখানার নিবু নিবু আলোতেও জীবনের রাস্তা গুলো কত পরিষ্কার দেখতে পাই পিকলু দার কথাতে। জীবনে কত কিছু করার ইচ্ছে উড়ান দেয়, পরের দিনের ভোর টা আমার জন্য অপেক্ষা করছে এটা ভাবতে ভালো লাগে। সকাল থেকে রাত অব্দি ভাবা সমস্যাগুলো কোথায় যেন হারিয়ে যায় আর অদ্ভুত ভাবে সব সমস্যারই একটা সমাধানের রাস্তা নিজেই খুঁজে পাই। এই যেমন , আজ যে গিফট কেনা হলো না, তার সহজ সমাধান - সাউথ সিটি মল তো রবিবারও খোলা থাকে!
-"পিকলু দা, তোমাকে দেখে আমার খুব হিংসা হয় জানো?" পেটে পড়লে মানুষ কত নিঃসংকোচে সত্যি কথাটা বলতে পারে।
-"এই রে কেনো? আমি আবার কি করলাম? তুই তো আমার ছোট ভাইয়ের মতন। তোর সাথে আমার রেষারেষি হবে কেন? "
-"তুমি জীবনকে যে ভাবে সুন্দর ভাবে দেখতে পাও, সেটা আমি পাই না কেন?"
-"সেটা তুই দেখতে চাস না বলে। তুই চাইলেই হবে।"
-"বাজে কথা বলো না। এই যে তুমি বললে তোমাকে আজ তাড়াতাড়ি বাড়ি ফিরতে হবে, বৌদিকে বলে এসেছ আর এখন প্রায় দশটা। এর পরে যখন বাড়ি ফিরে অশান্তি হবে তখনও তুমি বলবে যে তুমি ওই অশান্তিকে দেখতে পাবে না। "
পিকলু দা হো হো করে হাসছে। সোচ্চার হাসি, কান্না এখানে চেপে না রাখলেও চলে, কেউ কিছু মনে করে না, অভিনয় করতে হয় না। পিকলু দা কে দেখে আমার ও ওই রকম ভাবে মন খুলে হাসতে ইচ্ছে করছে, ভুলে গেছি কবে ওই ভাবে হেসেছিলাম।
-"সিরিয়াসলি পিকলু দা, আমার জানতে ইচ্ছে করছে তুমি কি ভাবে এই অশান্তির থেকে নিজেকে মুক্ত করে রাখো। প্লীজ আমাকে একটু শেখাবে?"
-"তুই শিখতে চাস?"
-"একদম"।
আমি গোগ্রাসে পিকলু দার দিকে তাকিয়ে । ছোটবেলার ক্লাসের অনুসন্ধানী মন নিয়ে। চোখ, কান, মুখ, নাক সব খোলা। চেটেপুটে শিখতে আমি চেয়ার টা আরো এগিয়ে নিয়ে পিকলু দার প্রায় কোলে উঠে পড়ি আর কি!
-"মোবাইল টা বার কর"। বাধ্য ছেলের মতন মোবাইল বার করে ধরে আছি। মনে হচ্ছে, আলাদিনের আশ্চর্য প্রদীপের মতন মোবাইল থেকে জিন বেরিয়ে এসে সব অশান্তি দূর করে দেবে।
-"এবার বউকে ফোন কর"।
-"তোমার কি মাথা খারাপ হয়ে গেছে? মাতাল হয়ে রাত সাড়ে দশটার সময় বউকে ভালোবাসার কথা শোনাবো? তুমি কি চাও একদম প্রেম দিবসে ই আমাকে উকিল খুঁজতে বের হতে হবে? "
-"ধুর বোকা। যা বলছি সেটা কর।"
-" বুঝতে পেরেছি। অশান্তির কারণটা একদম জীবন থেকে বার করে দেবার রাস্তা দেখাচ্ছো। তোমার বুদ্ধির তারিফ না করে পারছি না।"
-"ওই যে বলেছিলাম না, তুই অশান্তি দূর করতে চাস না, চাইলেই দূর করতে পারিস।"
-"সরি পিকলু দা। মাতাল হতে পারি, গাধা নই। আচ্ছা, তুমি এখন বৌদি কে ফোন করতে পারবে?"
-"আমি এমনিতেই করতাম। ভালো বলেছিস, তোর সামনেই না হয় স্পিকার ফোনে কথা বলছি , শুনে নে আমাদের ভালোবাসার কথা।"
কি রকম একটা অস্বস্তিকর পরিবেশ। নিজেকে খুব ছোট লাগছে। পিকলু দা কে এটা না বললেই পারতাম। স্বামী - স্ত্রীর মধ্যে কথা এই ভাবে জনগণের মধ্যে শুনতে হবে!
-" না, না পিকলু দা তোমাকে ফোন করতে হবে না। আমি জানি তুমি ফোন করতে পারবে, তোমাদের মধ্যে সেই সম্পর্ক টা আছে।"
-"গুলি একবার বন্দুক থেকে বেরিয়ে গেলে তো আর ফিরে আসে না বাবা। " - পিকলু দা ফোন করে দিয়েছে।
-"তোমার না আজকে সন্ধ্যে সন্ধ্যে ফেরার কথা? আজকে আবার আকন্ঠ গিলেছ তো? ড্রেনে পড়ে থাকবে না কি ঘরে আসতে পারবে?" - সত্যি গুলি বেরোচ্ছে এ কে ফর্টি সেভেন থেকে। অশান্তির ওষুধ খুঁজতে বের হওয়া আমার জাগ্রত কান লাল হচ্ছে বুঝতে পারছি। পিকলু দার জন্য খুব খারাপ লাগছে। ভ্যালেন্টাইন ডের গিফট ও কেনা হলো না, রবিবারের সকাল সকাল ঘুম থেকে উঠতে হবে। ইস কেন যে মরতে পিকলু দার কথা তে আজ বসার জন্য রাজি হয়ে ছিলাম!পিকলু দার কিন্তু কোনো ভাবের পরিবর্তন দেখলাম না।
-"বলছিলাম কি, কালকে ভাবছিলাম মাছের মাথা দিয়ে একটু পুঁই শাকের চচ্চড়ি হলে কেমন হয়? শীত টাও চলে যাচ্ছে, এই শীতে তো তোমার হাতের পুঁই শাকের চচ্চড়ি টাও খাওয়া হলো না। কিন্তু তোমার যা খাটা খাটনি যায়, ছুটির দিনে আর কষ্ট দিতে ইচ্ছে করে না। "- আমি নিজের কান কে বিশ্বাস করতে পারছি না। এটাও কি সম্ভব?
-"সকাল সকাল বাজার না গেলে ভালো পুঁই শাক পাবে কি? তুমি তাহলে রাতে না ফিরে সকালেই একেবারে বাজার করে ফিরো।"
-"এই তো ফিরছি। আজ রাতে কি রান্না হলো?"
আমার পক্ষে আর শোনা সম্ভব না। হাতে পায়ে ধরে পিকলু দার ফোনটা শেষ করালাম। ধন্যি ওদের একুশ বছরের প্রেম ভালোবাসা।
-"কি বুঝলি?"
-"বুঝলাম যে, আমি কোনো দিনই অশান্তি থেকে মুক্তি পাবো না কারণ তোমার মতন সহজ, সরল বায়না আমি কোনো দিন করতে পারবো না।"
-"পারবি পারবি। অফিসের শক্ত শক্ত হিসাব করতে পারিস আর সেখানে তো বায়না করা তো জল ভাত। একবার বায়না করে দেখ, অভিজ্ঞতা বলছে, নিরাশ হবি না। দেখবি কি রকম নতুন নতুন বায়না করতে ইচ্ছে করবে, আর আমি তো আছি, আমার সব পুরনো বায়নার ভান্ডার নিয়ে।"
আমি হতবাক এবং নির্বাক। রেস্টুরেন্টের হালকা নীলচে আলোতে আমার দীক্ষাদান হচ্ছে। আলাদিনের জিন আমার সামনে বসে আমাকে ভবিষ্যতের সোনালী দিনের স্বপ্ন দেখাচ্ছে। বায়না পূরণের প্রতিশ্রুতি, জীবনকে রূপ,রস,গন্ধে সাজিয়ে তোলার এক এবং একমাত্র অবলম্বন। আমি কোনো দিন এই রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রী হলে, পিকলু দার বায়নার ভান্ডার নিয়ে একটা বই লিখব আর সেই বইকে প্রত্যেক বিবাহিত পুরুষের পাঠ্য পুস্তক হিসাবে পড়ানোর সুপারিশ করতাম সেই নিয়ে সন্দেহ নেই।
বায়না নিয়ে ভাবতে ভাবতে আজকের রাতের ঘুমটা বেশ ভালো হবে, খুশিয়াল মন আগামী ভোরের জন্যে অপেক্ষা করছে - জীবন টা কলকাতার মায়াবী রাতের মতনই সুন্দর আর আকর্ষণীয়।




Comments