সকালের চা
- Abhijit Chakraborty

- Apr 18, 2020
- 3 min read

বিগত বারো দিন হয়ে গেল বিশু দার চায়ের দোকানের ঝাঁপ বন্ধ। আয়লা - ফণী - বুলবুল কেউ ই বিশু দা'র চায়ের দোকানের সকালের আড্ডা বন্ধ করতে পারে নি অথচ কোথা থেকে সস্তার আমদানি করা চিনে মাল এই রকম টিকে যাবে , সেটা দুঃস্বপ্নেও ভাবা যায় নি।
ছোটবেলায় হাত ধরে বাবা দোকানে বসিয়ে দিয়েছিল চায়ের গ্লাস গুলো ধুয়ে দেবার জন্য। আগাম কোন খবর না দিয়ে , অলুক্ষণে এক সকালে , পনেরো বছরের বিশু দা'কে সংসারের সমস্ত দায়িত্ব চাপিয়ে বাবা হুশ করে ভ্যানিশ হয়ে গেল তারাদের মাঝে। ছোট ভাই, বোন আর মায়ের পেটের ভাত জোগাড়ের জন্যে বিশু দা 'র পড়াশোনা আর বেশিদূর করা হলো না।
দোকান না খুললে পেটের ভাত জুটবে না, এটা জীবনের একদম শুরুতেই বুঝে গিয়ে বিশু দা দোকান টাকেই জীবনের সব ভালোবাসা অর্পণ করে চিরকুমার সভার পাকাপাকি সদস্য পদ নিয়ে নিয়েছিল। যাকে ভালবেসেছ তাকে সুখে রাখার দায়িত্ব পালনে কোনো রকম গাফিলতি হয় নি বিগত বিয়াল্লিশ বছরে। সেই ভালোবাসার প্রতিফলন - আঠেরো থেকে আশি সবার কাছের বিশু দা'র চায়ের দোকান।
সকাল সকাল দোকানের সামনের হলুদ বেঞ্চিতে বসলেই কারুর আর খবরের কাগজ পড়ার দরকার হয় না। রোনাল্ড রেগন থেকে ট্রাম্প, ইন্দিরা থেকে মোদী, মারাদোনা থেকে মেসি, সুনীল থেকে কোহলি, অমিতাভ থেকে আমীর, রতন টাটা থেকে মুকেশ আম্বানি প্রত্যেকের ঠিকুজি কুষ্ঠির টাটকা তাজা মুখরোচক খবর এখানে পাওয়া যায়। এখান থেকেই রাতের শেষ চায়ে চুমুক দিয়ে অফিস ফেরৎ কেরানি , প্রেমে ল্যাং খাওয়া বেকার আর মেয়ের বিয়ে দিতে অসমর্থ বাবা বাড়ি ফেরে পরের দিনের যুদ্ধে নামার রসদ জুটিয়ে। কলের মিস্ত্রি থেকে জীবনদায়ী রক্তের খোঁজ - পাড়ার জাস্ট ডায়াল বিশু দা'র চায়ের দোকান।
ভাই কে পড়াশোনা শিখিয়ে , বোন কে বিয়ে দিয়ে , বাবার কাছে মায়ের পৌঁছসংবাদ পেয়ে এখন বিশু দা ঝাড়া হাত পা। জীবনের শখ বলতে ওই চায়ের দোকানের মানুষগুলোর হাসি মুখ আর রাতে শুতে যাবার আগে শিবের প্রসাদ। সপ্তাহে একবার করে ভন্টে দা প্রসাদ দিয়ে যায়, সেটা দিয়েই সারা সপ্তাহ চলে যায়। গত সপ্তাহ থেকে সেটার ও সাপ্লাই নেই। বিশু দা চোখে অন্ধকার দেখছে। জীবন থমকে গেছে সব দিক থেকে । কলকাতার ধুধু করা রাজপথে নেমে আসা স্তব্ধতা আর শূন্যতা কে মেনে নিতে খুব কষ্ট হচ্ছে। নিজের জীবনের অসম্পূর্ণতা, দারিদ্র্য কে মেনে নিয়েছিল মুখ বুঝে নিজের কপাল কে দায়ী করে। কিন্তু জনমানবহীন , মৃত্যু ভয়ে নুইয়ে পড়া সন্ত্রস্ত মানুষ গুলোর অসহয়তা , বন্ধ দরজার ভেতর থেকে বিহবল চোখের বোবা কান্নার সামনে কাকে দায়ী করবে আজ?
অণুবীক্ষণ যন্ত্রে দেখতে পাওয়া ক্ষুদ্র থেকে ক্ষুদ্রতর অস্তিত্বের এত শক্তি যে পারমাণবিক অস্ত্রে শক্তিশালী মানুষ নিরুপায়! বিজ্ঞানের আলোয় উদ্ভাসিত , বিশ্ব ব্রহ্মাণ্ডের সবচেয়ে বুদ্ধিমান প্রাণী আজ নিজের অস্তিত্ব সঙ্কটে আতঙ্কিত। বুদ্ধির অহঙ্কারে গর্বিত মানুষের পরাজয় তাহলে কি নতুন কোনো দিক সংকেত দিচ্ছে? পার্থিব সুখের সন্ধানে দিকভ্রান্ত সকাল থেকে রাত ছুটে চলা নাগরিক জীবনকে থামিয়ে দেওয়া সময় তাহলে কি আবার করে জীবনের মূল্যবোধ কে ভাবতে বলছে? নিজেকে চেনার সময় নেই - এই অজুহাত থেকে মুক্তি দিয়ে নিজেকে খুঁজতে বলার জন্যই কি এই অবকাশ? মানসিক ভাবে একাকীত্বে ভোগা সমাজকে চোখে আঙ্গুল দিয়ে তাঁর দীর্ণতা প্রমাণ করার জন্যই কি সামাজিক দূরত্বের আয়োজন?
এতদিন বাদে বাবার উপর রাগটা ফিরে আসছে। আরো কিছুদিন বাবা মাথার উপরে ছাতা টা ধরে থাকলে পড়াশোনাটা আরো একটু করা থাকতো। উত্তর গুলো পেতে সুবিধা হতো।
কাল সকাল সকাল একবার পুলিশের কাছে যাওয়া টা খুব দরকার । এতদিনের চেনা , স্পেশাল পারমিশন নিশ্চয় ই পাওয়া যাবে দোকান টা খোলার। নাহ্, কোনো চা বিক্রি করবে না, দোকানের সামনে খালি বেঞ্চ টা শুধু পেতে রাখবে। আগামীর ভোর নতুন পৃথিবীকে সাদরে বরণ করার অপেক্ষায় দিন গুনছে, হারিয়ে যাওয়া মূল্যবোধ আর ক্ষয়ে যাওয়া সম্পর্ক গুলোর ফিরে পাওয়ার শুভ মুহূর্তকে সাজিয়ে তুলবে বলে। কোলাহলমুখর কল্লোলিনী কলকাতার রাজপথে জীবনের কলরব, প্রাণ ফিরে পাওয়া নাগরিক জীবনের স্বপ্ন পূরণের প্রতীক - বিশু দা'র চায়ের দোকান আর সামনে পাতা বেঞ্চ।
আর মাত্র কয়েক টা দিন !




Comments