top of page

পঁচিশে বৈশাখ

  • Writer: Abhijit Chakraborty
    Abhijit Chakraborty
  • May 10, 2020
  • 3 min read

ree

একটু ফুলকো লুচি আর সাদা আলুর তরকারি, তার জন্যে যে এত জল বয়ে যাবে জীবনের নদীতে সেটা হবু জ্যাঠা বোধহয় কোনোদিন ভাবতে পারে নি। মধুমেয় রোগ আর পাঞ্জাবির ফাঁকা পকেট নিয়ে লুচি - আলুর তরকারি খাবার সাহস কোথা থেকে আসে! এটা খেয়ো না, ওটা ধোরো না , ওখানে যেও না - চারিদিকে শুধু না , না আর না। আর তারমধ্যে সকাল সন্ধ্যে করোনা, করোনা আর করোনা। ঘরের এক দিক কালো হয়ে জ্বলা টিউবের আলোর মতন হবু জ্যাঠার এখনকার জীবনটা ফ্যাকাশে। গবু কাকু টাও কি রকম ভেজানো মুড়ির মতন মিইয়ে গেছে ! অথচ কিছু বছর আগে হলেও হবু জ্যাঠা আর গবু কাকুর যুগলবন্দী তে এলাকার কাউন্সিলর থেকে পুলিশ একঘাটে জল খেত।


সামান্য দুটো ফুলকো লুচির জন্যে এত গঞ্জনা! দিন পাল্টেছে, রাজত্ব ও পাল্টেছে। একটা হাঁক দিলে , থালা ভর্তি লুচি, সাদা আলুর তরকারি, গোটা চারেক নাদুসনুদুস রসগোল্লা হাজির হতো। রাস্তায় বেরোলে মাথায় ছাতা কে ধরবে সেই নিয়ে সপ্তাহের রস্টার তৈরি করতে হতো। ছোটবেলায় বাবার শেখানো আদর্শ ও কলেজ জীবনে সমাজ সংস্কার করার শপথ কে বাস্তবে রূপদান করতে কাক ভোর থেকে মাঝ রাত মানুষের সাথে থাকার অঙ্গীকার - হবু জ্যাঠার অহংকার। ওল্ড স্পাইস‌‌ আর গোল্ড ফ্লেকের গন্ধের ককটেলে জীবন তখন পরিপুর্ণ।


গবু কাকু ই খবরটা প্রথম জানতে পেরেছিল। কাবুর ভালোবাসার কথা। হবু জ্যাঠা বলেছিল, বয়সকালে সবার ই ওই রকম এক - আধটু ভালোবাসার নেশাতে নেশাতুর হতে ভালো লাগে। গবু কাকুর আগাম সতর্ক বার্তাকে ফুঃ দিয়ে উড়িয়ে দেওয়া হবু জ্যাঠা তখন সমাজ উদ্ধারে ব্যস্ত , নিজের ছেলের ব্যাপারে সময় দেওয়া বিলাসিতা। গবু কাকু অনেকবার বোঝাতে চেষ্ঠা করছিল - বয়েস টা ভালো না, ছেলের জন্যে একটু সময় দাও , একটু বন্ধুর মতন মেশো।


কলেজ যাওয়া বন্ধ, মাঝেই মাঝেই ভোর রাতে টলমল পায়ে বাড়ি ফেরা। গলায় সোনার পুরু চেন, হাতে নতুন মোবাইল। পয়সার যোগানের উৎস সম্বন্ধে প্রশ্ন করলে, ছোট্ট উত্তর - ব্যবসা ভালো চলছে। গবু কাকুর টিকটিকিরা খোঁজ এনে দিল - তোলা ব্যবসাতে পকেটে কাঁচা পয়সার সুযোগ প্রচুর। আশে পাশে কত প্রোমোটার ফ্ল্যাট তৈরি করছে। কাবু কে সোনার হরিণের হদিশ দেবার মানুষের সন্ধানও পাওয়া গেছে। হবু জ্যাঠার পাড়াতুতো বোন - মান্তা পিসি।


হবু জ্যাঠা আর মান্তা পিসেমশাই - রাজনৈতিক আদর্শের দুই ভিন্ন মেরুতে অবস্থান করা দুজন মানুষ। দুজনেই মানুষের পাশে থাকতে চায় - একজন আদর্শের কারণে আরেকজন ক্ষমতার শিখরে পৌঁছনোর লক্ষ্যে। সময়ের সাথে দুজনের চরম বৈরিতার ফলাফল - শিখণ্ডী রূপী মান্তা পিসি, কাবু কে বেছে নিল স্বামীর লক্ষ্যপুরণের হাতিয়ার হিসাবে।


ছোটবেলা থেকে বাবা কাছে থেকেও নেই। দু - চোখ ঘুম নিয়েও অনন্ত অপেক্ষা, রাতে এসে বাবা যদি একটু গল্প করে, একটু আদর করে। ছোট্ট কাবুর মনের ভিতর সুপ্ত অভিমান আর বাবার কাছে চেয়ে না পাওয়া দামি জামা, জুতো আর খেলার সরঞ্জাম হাতের কাছে পাওয়ার অভ্যেস মান্তা পিসিকে খুব কাছের মানুষ করে তুলেছিল যৌবনের চৌকাঠে দাঁড়ানো বিভ্রান্ত এক কিশোরের মনে। বাবার প্রবল প্রতিপত্তি থাকা সত্ত্বেও নিজেদের নিরাম্বর জীবন যাপন করার প্রহসন কে মেনে নেওয়ার বিরুদ্ধে জিহাদ ঘোষণা শুধু সময়ের অপেক্ষা ছিল।


চোখের সামনে রঙ্গীন পৃথিবীর জাগতিক গোপন আনন্দের পর্দা গুলো একটার পর একটা খুলে যাচ্ছে মান্তা পিসির বীজ মন্ত্রে। অৰ্থ ই জীবনের সুখ ও শান্তির একমাত্র গোপন চাবি কাঠি। সেই অর্থ রোজগারের রাস্তাটাও কত সোজা ! শুধু নিজের বাবার নামের প্রতিপত্তি দেখিয়ে নিজের দাবি হাসিল করে নেওয়া, আর যেখানে পুলিশ ও বাবা কে ছুঁতে সাহস পায় না। মান্তা পিসীর অব্যর্থ ওষুধে বাবা - ছেলের কোন্দল পাড়ার দারুণ এক জমাটি সোপ অপেরা। জেঠিমার কান্নাকাটি , গবু কাকুর দুজনকে আলাদা আলাদা করে বোঝানো, কোনো কিছুই বৈশাখের তপ্ত আগুন কে নেবাতে পারে না।


বছর সাতেক আগের পঁচিশে বৈশাখ। রজনীগন্ধা আর বেল ফুলের গন্ধ আকাশে বাতাসে। বাকি বছর গুলোর প্রভাত ফেরীর ফুলের গন্ধের সাথে একটা কড়া ধূপের গন্ধ এবার যোগ হয়েছে। সোপ অপেরার শেষ পর্বে, বাড়ির উঠোনে কাবুর নিথর দেহ, সাথে পুলিশ। হবু জ্যাঠার প্রতিপত্তির শেষ উদাহরণ - পোস্টমর্টেম টা হয় নি। শেষ পর্বের কাহিনীকার কি হবু জ্যাঠা না কি মান্তা পিসেমশাই?


আজও পঁচিশে বৈশাখ। কাবুর প্রিয় লুচি ও সাদা আলুর তরকারি নিয়ে সামনে বসে সত্তরোর্ধ্ব দুটি নির্বাক মানুষ । কাল সকালে আবার বেড়িয়ে পড়তে হবে হবু জ্যাঠাকে, জেঠিমার অশক্ত হাতে তৈরি কাপড়ের মাস্ক গুলোকে মেথর বস্তিতে বিলি করার জন্যে। ঘিণ্জি বস্তির মানুষ গুলো সরকারের কাছে কিছু সংখ্যা মাত্র যা সময়ে অসময়ে ব্যবহার করা যায় কিন্তু সেই বস্তির আলো ঢুকতে না পারা ঘরের এক একজন বাকি ঘরের মানুষগুলোর কাছে পুরো পৃথিবী। ঘরের কোণে টেবিলের উপর রাখা ভাঙ্গা রেডিওতে জর্জ বিশ্বাস আজও গাইছেন বাকি বছর গুলোর মতন, অমলিন জীবন দর্শনে মাথা উঁচু করে।


"জীবনমরণের সীমানা ছাড়ায়ে,

বন্ধু হে আমার , রয়েছ দাঁড়ায়ে..."





Comments


©2020 by Hizibizi Online

bottom of page