top of page

রামের রংবাজি

  • Writer: Abhijit Chakraborty
    Abhijit Chakraborty
  • Apr 1, 2023
  • 5 min read

কলকাতা তে হটাৎ করে রাম পূজোর হিড়িক দেখে কদিন ধরেই মাথার পোকা টা আবার এদিক ওদিক নাড়াচাড়া দিচ্ছিল। অনেক কষ্টে পোকা টাকে ঘুম পাড়ানোর ওষুধ খাইয়ে শান্ত রেখেছি। বছর শেষের ইঁদুর দৌড়ের অঙ্ক মেলাতে হবে আগামী সাত দিনের মধ্যে। মাথাটা একটু শান্ত রেখে নিরিবিলিতে কাজ করা দরকার - সেই ভেবে বাড়ি থেকেই দোকান মানে ল্যাপটপ টা খুলে কাজ করছি, হটাৎ পাশ থেকে কুহুর কৌতূহলী গলার আদুরে আওয়াজ - "বাবা তোমার আজ অফিস ছুটি? বাহ্ বেশ, আমার ও স্কুল ছুটি, তোমার ও। মায়ের অফিস টাই বাজে, কোনো ছুটি দেয় না।'


কিছু উত্তর দেবার আগেই, পরবর্তী প্রশ্ন - "আজ আমার জন্য নিশ্চয়ই তোমার সময় আছে?'। মনে মনে প্রমাদ গুনছি। মেয়ের পরীক্ষা শেষের দশ দিনের ছুটির ব্যাপারটা একদম ভুলে মেরে দিয়েছি । অফিস না যাবার ডিসিশন টা এবার নিশ্চিত বুমেরাং হয়ে আসবে। মায়ের থেকে শেখা কথাগুলো ঠিক কোথায় কোথায় ব্যবহার করতে হবে সেটা বছর পনেরো মেয়ের খুব ভালো জানা আছে।


অফিস রাজনীতির থেকে শেখা বাণী - অফেন্স ইস দ্য বেস্ট ডিফেন্স । শত্রু কে খুব বেশি সময় দিও না ঘর গোছাতে।


-"কেন? কোন সময় তোর জন্য আমার সময় থাকে না, একটু বলবি ?'

-"বাজে কথা বলো না। বাড়িতে থাকলেও তো সেই সারাক্ষণ ওই ল্যাপটপের মধ্যে মুখ গুঁজে থাকো, না হলে ফোনে। আর এই দুটো না হলে টিভি তে ফুটবল। বাকি সময়টা কোন জগতে থাকো সেটাও বুঝতে পারি না। তিনটে প্রশ্ন করলে একটার উত্তর আসে, সেটাও ওই হ্যাঁ বা না তে। কি যে ছাইপাশ সারাক্ষণ ভাবো সে তোমার ওই অফিসের লোকেরাই বলতে পারে। তারাই তো তোমার সাথে বেশিক্ষণ থাকে।'


হাটু মুড়ে অস্ত্র সমর্পণ করা ছাড়া কোন উপায় নেই। ভবিষ্যতের কথা ভেবে আত্মসমর্পণও যুদ্ধের এক কুশল রণনীতি। অফিসেরই এক শুভাকাঙ্ক্ষীর দেওয়া মূল্যবান পরামর্শ।


-"এই দেখ্ ল্যাপটপ বন্ধ করলাম।'

এক গাল ভরা ভালোবাসার হাসির মধ্যে যুদ্ধ জয়ের গর্ব ফুটে বেরোচ্ছে কুহুর ফর্সা নিটোল মুখে। এখনকার মতন বাবার পুরো সময় ওর জন্য।


-"বাবা, তোমাদের অফিসেও কি রাম পুজো হয়?'

-"মানে??' আমার চোখ ছানাবড়া।

-"রাম পুজোর জন্য তাহলে ছুটি দিল কেন?'


কি করে বোঝাই, নিজের পেট পুজোর ব্যবস্থা ঠিক রাখার জন্য আমি অফিস না গিয়ে বাড়িতে বসে কাজ করছি। প্রসঙ্গ বদলানো দরকার।


-"তোর হটাৎ এই বছর রাম পুজো নিয়ে এত মাথাব্যথা কেন একটু বলবি?'

-"না, আসলে সকাল থেকে একটা জিনিষ মাথার মধ্যে ঘুরপাক খাচ্ছে রাম কে নিয়ে।'


পনেরো বছরের বাঙালি মেয়ের মাথাতে রামের চিন্তা ! সমাজের কি উন্নতি, ভাবাই যাচ্ছে না। সমাজের বিকাশ কেউ আটকাতে পারবে না। দেশ একদম সঠিক পথে এগোচ্ছে। হিন্দু রাষ্ট্র শুধু সময়ের অপেক্ষা ।


-"রাম না রামু ? কার কথা ভাবছিস, ঠিক করে বল।'

-"রামু টা আবার কে?'

- "কেন তুই রামু কে চিনিস না? সকালে যে রোজ দুধ আর খবর কাগজ দিয়ে যায়।'

-" না , আমি তোমার কোনো রামু ফামু কে চিনি না। শুধু আজেবাজে বকো তুমি।'


সময়কাল খারাপ। ক্লাস টেনের মেয়ের মন কোন রামু যে কখন চুরি করে নিয়ে যায়, সেই টেনশন আর কি করে বোঝাবো?


-"আচ্ছা রামু কে বাদ দিলাম। আপাতত রাম কে নিয়ে কি ব্যাপার তোর মাথায় চলছে সেটা শুনি।'

- "রাম কি ভালো না খারাপ ?' - জীবনে অনেক রকম উদ্ভট প্রশ্ন শুনেছি অনেকের থেকে, এখন নিজের মেয়ের থেকে ও এই ধরনের আজগুবি প্রশ্ন!


একটু কূটনৈতিক উত্তর দেবার চেষ্টা করলাম - "কোনো মানুষ কে ওই ভাবে ভালো বা খারাপ বলা যায় না। সব মানুষের মধ্যেই কিছু ভালো, কিছু খারাপ মিলিয়ে মিশিয়ে থাকে।'

- "রাম তো ভগবান। ভগবান তো খারাপ হতে পারে না।'

- "সেটা ঠিক। রাম তাহলে ভালো।' মনে মনে ভাবছি, অল্পতে রেহাই পাওয়া গেল। পরের প্রশ্নেই বুঝলাম , আমার ভাবনার সে গুড়ে বালি।

-"তাহলে তুমি প্রথমেই আমার উত্তরে "ভালো" না বলে অত কিছু বললে কেন?'


নিজের মেয়ের সামনে নিজেকে বড় অসহায় লাগছে ! বাঙালির অভ্যাস - যে কোনো ঠাকুর, ভগবান কে  মানুষ হিসেবে কল্পনা করা। আর, রাম কে মানুষ হিসেবে ঠিক কোনোদিন ই আমার সুবিধার বলে মনে হয় নি । কি রকম সন্ধেহ বাতিক একটা লোক। নিজের বউকে ছেলের সামনে, সমাজের সামনে অগ্নিপরীক্ষা তে বসতে বলে?


নিজের মনের ভাবকে যথাসম্ভব চেপে রেখে একটা উত্তর খাড়া করার আপ্রাণ চেষ্টা করলাম - "আমরা বাঙালিরা তো একটু ডানপিটে ধরনের মানুষ পছন্দ করি । এই একটু সাহসী , অদমনীয় , বেপরোয়া । তার সাথে একটু সৃজনশীল মনন। তাই, 'রাম' যদি শুধু নিপাট ভদ্রলোক ধরনের মানুষ না হয়ে একটু রোমান্টিক আর বোহেমিয়ান হতো তাহলে মনে হয় একবারে ই "ভালো" বলতাম'।


নিজের উত্তর শুনে, নিজেই মনে হেসে ফেললাম। একটা মানুষ নিজের অধিকারের রাজমুকুট বৈমাত্রেয় ভাইয়ের হাতে অবহেলায় তুলে দিয়ে বনে বাঁদাড়ে ফলমূল খেয়ে দিন কাটালো তারপর এদিক ওদিক থেকে বানর সেনা জোগাড় করে সমুদ্রে পাথর ফেলে রাস্তা তৈরি করে বিদেশ থেকে নিজের বউকে উদ্ধার করে আনল, তারপর ও তার কাজের মূল্যায়ন - "ভালো কাজ করেছ, কিন্তু তোমার থেকে আরো অনেক বেশি প্রত্যাশা ছিল।'


কুহুর প্রশ্নবাণ থামলো না। আমি যে রকম উত্তর দিয়েছি তাতে থামার কথাও না।


-"আমরা কি অদ্ভুত তাই না? যেটা আমরা নিজেরা নই বা আমাদের মধ্যে যেটার অভাব, ঠিক সেটাই আমরা পছন্দ করি। আমি তো তোমার মধ্যে কোনো বেপরোয়া, বোহেমিয়ান ভাব দেখতে পাই নি। তুমি ও তো সারাক্ষণ মায়ের ভয়ে চুপ করে থাকো। তুমি নিজে যেটা পারো না, সেটা অন্যের কাছ থেকে আশা করো কি করে?"


উফফ, আর কত অপমান সহ্য করবো রে বাবা! ঘরে, বাইরে কোথাও একটু দু - দণ্ড শান্তি নেই?


-"আমার কথা বাদ দে। আমি তো সমগ্র বাঙালির কথা বলেছি। তুই কটা বাঙালি কে চিনিস? তুই রাঙা কাকু কে চিনিস?' - বাঙালি গর্জে উঠেছে।


-"কে আবার তোমার এই নতুন রাঙা কাকু হটাৎ করে উদয় হলো?'


আমি রাঙা কাকু কে নিয়ে আমার গল্পের ঝোলা খুলে  বসেছি। চোখের সামনে একটার পর একটা দৃশ্য ভাসছে।


উত্তর কলকাতার লাল রকে বসা চুয়াত্তর বছরের এক যুবককে ঘিরে একটা নিম্ন মধ্যবিত্ত পাড়া। সরকারী চাকুরী থেকে অবসরের পরেও ব্যস্ততার কোনো অভাব নেই। এই বছর পাড়ার পুজোর পঁচাত্তর বছর। তার তোড়জোড় এখন এই মার্চ মাস থেকে। সেই তোড়জোড়ের কেন্দ্রবিন্দু ওই চুয়াত্তরের রাঙা কাকু।


সকালে ঘুম থেকে উঠে গাঢ় চিনি দিয়ে দুধ চা আর তার সাথে মিনি গোল্ড ফ্লেক দিয়ে দিন শুরু হয় রাঙা কাকুর। তারপর বাজারের থলে টা নিয়ে বাজার যাবার পথে প্রথমেই পাড়ার ক্লাবে গিয়ে সারাদিনের একটা পরিকল্পনা। কারো জন্য রক্তের যোগান, কারো জন্য পেট চালানোর মতন কোনো কাজের সুপারিশ অথবা কাউকে পুলিশ বা আদালতের থেকে মাথা উচুঁ করে ছাড়িয়ে নিয়ে আসা। পাড়ার ক্লাবে এখনও সরকারি অনুপ্রেরণার অনুদান এসে পৌঁছতে পারে নি। কারণটা অবশ্য ই রাঙা কাকু। সাদা পাঞ্জাবি চুইয়ে পড়া পুরুষালি ঘাম ঝরিয়ে সারা বাজার ঘুরে ঘুরে বাঙালির বাজার করতে না পারলে দিন টা যেন কেমন ম্যাজম্যাজ করে। ফ্রিজে রাখা সবজি বা মাছ মাংস - এতে কোনো স্বাদ ই পাওয়া যাওয়া না। আঠাশ বছর ধরে হাই সুগার। তাতে রাঙা কাকুর বয়ে গেছে। পাঁঠার মাংস ছাড়া বাকি সব রান্না, রাঙা কাকুর কাছে নিরামিষ। বছর সাতেক আগে গোটা চার স্টেন্ট বসেছে, তাতেও খাবারের উপর কোনো নজরদারি বসানো যায় নি।


বাজার করে বাড়ি এসে একটু শরীরটা কে ফ্যানের তলা তে ঠান্ডা করে নিয়ে গোটা পাঁচেক লুচি আর সাদা আলুর দম দিয়ে প্রাতরাশ। লুচি ছাড়া অন্য কিছু দিয়ে বাঙালি সকালের খাবার খেলে সেটা এক রকম অপমান বলে মনে হয় রাঙা কাকুর।


বিগত মাস সাতেক ধরে দুপুরে খাওয়া দাওয়ার পর রাঙা কাকুকে প্রায়ই বেরোতে হচ্ছে। চৈত্রের কাঠ পোড়া রোদ কোনো বাঁধা হয়ে উঠতে পারে নি। কতগুলো বাচ্চা ছেলেমেয়ে নিজেদের নৈতিক অধিকার নিয়ে বছর খানেকের উপর কলকাতা ময়দানে অবস্থান করছে। সরকারের খামখেয়ালীর প্রতিবাদ স্বরূপ এদের পাশে দাঁড়ানো টা রাঙা কাকুর বিবেকের জন্য খুব জরুরী।


রোদে পুড়ে যাওয়া চামড়ার ওষুধ হিসেবে সপ্তাহে দিন তিনেক ক্লাবে বসে একটু সুরাপান করতে হবে - এই সুপরামর্শ টা কোনো ডিগ্রিধারী ডাক্তার করতে পারবে না, তাই রাঙা কাকু ডাক্তার থেকে কয়েক যোজন দূরে নিজেকে রাখতে ভালোবাসে। ছেলে, ছেলের বউ, স্ত্রী কেউ কোনো দিন এর থেকে এক বিন্দু টলাতে পারে না। মাঝে মাঝে, কিছু সন্ধ্যেতে গ্লাসে রঙিন জলের মাত্রাটা একটু বেশি হয়ে গেলে, পাড়ার ছেলেরাই টলমল পায়ে কাকুকে বাড়ি পৌঁছে দেয়। রাঙা কাকুর সুপ্রতিস্থিত স্বচ্ছল ছেলে আধুনিক কলকাতার সুসজ্জিত কমপ্লেক্সে ফ্ল্যাট নিয়েও নিজের বাবাকে সেখানে নিয়ে যেতে পারে নি। কাকু ও কাকিমার উপর এই উত্তর কলকাতার পাড়ার অনেকে যে ভীষণ ভাবে নির্ভর। আর্থিক ও মানসিক ভাবে।


রাঙা কাকুকে নিয়ে আমার গল্প থামতেই চায় না।


-"দারুণ ইন্টারেস্টিং ক্যারেকটার তো! বাবা, একদিন চলো তোমার রাঙা কাকুর সাথে দেখা করে আসি। রামের ব্যাপারে আমার ডিসিশন টা অনেক সহজ হয়ে যাবে'। কুহুর চোখ চকচক করছে।


আমি চুপ করে থাকি। কুহু বারেবারে জিজ্ঞাসা করতে থাকে, কি হলো কবে যাবো আমরা?


-"রাঙা কাকুর রংবাজী আর দেখতে পাবো না রে। গত সপ্তাহে হুঁশ করে হাউই বাজির মতন হারিয়ে গেছে কাকু। চিরদিনের জন্য'।


শান্ত দুপুরের সিলিং ফ্যানের হাওয়ার শব্দ ছাড়া বাকি সব নিশ্চুপ। নিস্তব্ধতা ভাঙ্গে কুহুর শেষ প্রশ্নে - "রাঙা দাদু র মতন রোজ না হলেও তুমি কি মাঝে মাঝে ওদের সাথে ওদের পাশে বসতে যেতে পারবে?'


Comments


©2020 by Hizibizi Online

bottom of page