top of page

আম কাহিনী

  • Writer: Abhijit Chakraborty
    Abhijit Chakraborty
  • Sep 1, 2020
  • 6 min read

ree

"এখনো তো আসে নি। কখন আসবে? না এবারেও কান ঘেঁষে বাংলাদেশে চলে যাবে? '

- সকাল থেকে দিয়ার তর সইছে না। আট বছরের দিয়াকে ওর বাবা গতকাল রাতে গল্প শুনিয়েছে "আয়লার'।  ঝড়ের পড় আম কুরোনোর গল্প। বাবা তখন অবশ্য দাদুর বাড়িতে থাকতো। দাদুর তিনতলা বাড়ি আর সাথে অনেক অনেক গাছ। বকুল, কৃষ্ণচূড়া, টগর, নিম,আম আর একটা নারকেল গাছ ও আছে। দাদুই চিনিয়েছে সবকটা গাছকে, ও যখন মাঝে মাঝে দাদুবাড়ি যায়। বড় জেঠু, মেজো জেঠু , ছোটকা সবাই ওই বাড়িতে থাকে। কি মজা হতো বাবাও যদি ওই বাড়িতে থাকতো - সব্বাই মিলে। মাকে দু - একবার জিজ্ঞাসা করেছিল ওরা কেন থাকে না। একটাই উত্তর - " বাবার অফিসের থেকে অনেক দূরে তো দাদুর বাড়ি !' ছোট্ট দিয়ার উত্তর টা পছন্দ হয় নি। মা নিশ্চয়ই কিছু লুকোতে চাইছে। যখনই দাদুবাড়ি গেছে, মা ওকে নিয়ে গেছে। বাবাকে কখনো দাদুবাড়ি যেতে দেখে নি।


সাত সকালে ঘুম থেকে উঠেই বাড়ির সামনের উঠোনে এসে দাঁড়িয়ে আকাশটা কে দেখে ঠিক ভালো লাগে নি সায়নের। ঝড়টা আসার কথা তো বিকেলের দিকে, কিন্তু এখনই যে রকম বাতাসের ধাক্কা, ভালোয় ভালোয় দিনটা কেটে গেলে হয় ! রায়দিঘী সেকেন্ডারি স্কুলের অ্যাসিস্ট্যান্ট হেডমাস্টার, কলকাতার বাবার তিনতলা বাড়ি ছেড়ে একতলার ভাড়াবাড়িতে প্রায় বছর ছয়েক হতে চললো। বিজ্ঞানের মনোযোগী ছাত্র, তিন প্রজন্মের ফুঁলে ফেঁপে ওঠা লেদের ব্যবসা পছন্দ হয় নি ছোটবেলা থেকে। সমাজের পিছিয়ে পড়া মানুষ গুলো কে একটু বিজ্ঞানমনস্ক করে তুলে ধরার মাথার ভেতরে পোকাটা কলেজ থেকেই নড়াচড়া করতে শুরু করেছিল।


শহর থেকে দূরে থাকা মানুষ গুলোকে একটু বেশি করেই যেন ভালোবেসে ফেলেছে। শত অভাব থাকলেও অভিযোগ টা কম। গতকাল থেকে যুদ্ধ পরিস্থিতিতে এই মানুষ গুলোকে সাথে নিয়ে প্রকৃতির অসীম শক্তির সাথে লড়াইয়ে নামার প্রস্তুতি চলছে। স্কুলের একতলার ল্যাবরেটরি থেকে সব সরঞ্জাম খুলে দোতলা তে নিয়ে যাওয়া , তিনতলার লাইব্রেরী রুমের ভাঙ্গা কাঁচের আলমারি গুলো কে ত্রিপল দিয়ে মুড়ে দিতেই সারা সন্ধ্যে চলে গেছিল। স্কুলের উঁচু ক্লাসের ছাত্রদের দিয়ে গ্রামের বাড়ি বাড়ি খবর পাঠিয়ে ঝড় ও তাঁর পরবর্তী দিন গুলোর প্রতিকূল অবস্থার মোকাবিলা করার আগাম সচেতনতা তৈরি করিয়েছে। এত কিছুর পরেও মনে কোথাও একটা অস্বাভাবিকতা - ঠিক ধরা যাচ্ছে না। বিপদের গন্ধ না কি অন্য কিছু!


মলি কে দিয়ে ভবানীপুরের বাড়িতে ফোন করে জানিয়ে দিয়েছে, ঝড়ের পর মোবাইলের কানেকশন না পাওয়াটাই স্বাভাবিক, তাই অযথা যেন চিন্তা না করে সায়ন বা মলির ফোন না পেলে।


বাতাসের ধাক্কার দাপট টা প্রতি ঘণ্টায় বাড়ছে। বাড়ির আশে পাশের গাছ গুলো কে সকালে দড়ি দিয়ে বেঁধে রেখেছিল, এখন সেই দড়ি গুলোও গাছের অস্থির ভাবে মাথা নাড়ানো তে খুলে গেছে। ভোর থেকে বৃষ্টি শুরু হয়েছে , এখন অবিরাম ধারায় ঝড়ের সাথে যুগলবন্দী তে মত্ত। প্রকৃতি আজ তার নিজের তাণ্ডব নৃত্যে মশগুল।


-" বাবা, ওই তো আম পড়েছে। '


কাউকে কোনো কথা বলার সুযোগ না দিয়ে, দিয়া এক দৌড়ে বাড়ির বাইরে , আম তুলতে। হরির লুটের মতন আম পড়ছে। দিয়ার আনন্দের প্রতিটা মুহুর্ত ওর চেনা। ভীষণ চেনা। আয়লার রাতে। ভবানীপুরের বাড়ির আম কুড়োনোর রাতের মুহুর্ত গুলো চোখের সামনে ছবির মতন ভেসে বেড়াচ্ছে।


মা চিৎকার করছে ।

-"অনেক তো বয়েস হলো, এখনও বাচ্চাদের মতন আম কুড়াবি? এই ঝড়ের মধ্যে আর বিপদ ডাকিস না।'


এই হলো মায়েদের মন। বিপদ কে খুঁজে আনতেই হবে। আর সব বিপদের ই এক ঠিকানা। কোলজুড়ে থাকা মানিকধন। সন্তানের সুরক্ষা নিশ্চিত করতে করতেই সারাটা জীবন কাটিয়ে দিল।


বাবা বাড়ির পেছনের দরজায় মুখে দাঁড়িয়ে।

-" আর একটু বাগানের কোণের দিকে যা, ওই দিকটার আমের ঝাঁক টা বেশি। '

নিজের জীবনের অতৃপ্ত বাসনা গুলোর পরিপূর্ণতা সন্তানের মধ্যে দিয়ে - বাবাদের স্বার্থপর ভাবনার গোপন আখাঙ্খা।


আম পড়ার আওয়াজ টা অনেক টা ছোটবেলায় বড়'দার হাতে চাটি খাওয়ার মতন। দু-একটা মাথায় পড়লে ছোটবেলার সেই কালো সাদা ফুলকি দেখা মনে করিয়ে দেবে, সে বিষয়ে কোনো সন্দেহ নেই।  বৃষ্টির মধ্যে আম কুড়োনোর অনাবিল আনন্দের কাছে ওই রকম দু-চারবার কালো সাদা ফুলকি দেখার কষ্ট নস্যি । অঝোরে বৃষ্টির মধ্যে নিজেকে সঁপে দেবার অপার্থিব অনুভূতি ছোট বেলা থেকেই। বৃষ্টির গন্ধ সারা শরীরে মাখামাখি। মাথার চুল বেয়ে পড়া জলের গতিপথের প্রতিটা বাঁক খুঁজে নেয়, মায়াবী ভালোবাসার অলীক কল্পনা কে।


-"ওরে অনেক হয়েছে এবার উঠে আয়। নারকেল গাছ টার দিকে যাসনা, ওটার অবস্থা ভালো নয়। তুমি কিছু বলতে পারছো না? '

সায়ন নিশ্চিন্ত। আপাতত বন্ধুকের নল টা ঠিক দিকে ঘুরে গেছে। এখন বেশ কিচ্ছুক্ষণের জন্য ওই দিকেই থাকবে। আম তোলা আর বৃষ্টির সাথে গল্প করার মধ্যে কোনো ব্যাঘাত ঘটবে না।


নারকেল গাছটা প্রায় হেলে পড়েছে বাড়ির দিকে। এবার একটু ভয় করছে সায়নের। যদি সত্যি সত্যি নারকেল গাছ টা ছাদের কার্নিশে পড়ে, তাহলে শুধু ছাদ নয়, রান্নাঘরের একদিকের দেওয়াল টাও ভাঙতে হবে।


বাড়ির পিছনের দিকে ঠিক দু পাশে দুটো নারকেল গাছ। বাড়ির জন্মলগ্নে পোঁতা । ব্যবসা বৃদ্ধির পরে পাশের জমিটাও কিনে নিয়ে সেখানে সুধীন বাবু, মানে সায়নের বাবা, তার মনের মতন বাগান করেছেন। কলকাতা শহরে তিনতলা বাড়ি ও লাগোয়া বাগানের মালিকানা তো দুর্লভ। শৌখিন সুধীন বাবু সেই দুর্লভ ব্যাপারটাই অর্জন করেছেন নিজের বুদ্ধিমত্তা ও সুযোগের সদ্ব্যবহার করে। নারকেল গাছ দুটো যেন বাড়ির দুই প্রহরী। সদা জাগ্রত, সমস্ত বিপদের থেকে রক্ষা করার জন্যে। তাই বাগান করেও গাছ দুটোকে তাদের স্থানচ্যুত করার কথা সুধীন বাবু কখনো ভাবেন নি।


দুই প্রহরীর স্বভাব একদম বিপরীত। বাড়ির দিকে মুখ করে তাকালে, বাম দিকের গাছের ডাব আর নারকেল খুব মিষ্টি। আর ডানদিকের গাছের নারকেলের ভিতর টা সব সময় কালো। জ্ঞানত অবস্থা থেকে আজ অবধি, সায়নের কোনোদিন মনে নেই যেদিন ডানদিকের গাছ থেকে সাদা নারকেল পাওয়া গেছে। সাদা ধবধবে নারকেলের রং এই রকম কালো কি করে হতে পারে সেই নিয়ে নানা মুনির নানা মত। মা ও পিসির বদ্ধমূল ধারণা ওই গাছটা তে ভুত আছে।  পিসির সাথে সায়নের এমনিতে খুব ভাব। বিজ্ঞানমনস্ক কিশোরের শিক্ষিকা হিসাবে ভাব টা আরো অনেক গভীর। এ হেন পিসির পক্ষে এই ভুত প্রেত নিয়ে বলাটা সায়নের পক্ষে মেনে নেওয়া কষ্টকর। বাবা বা দাদা রা এই ব্যাপারে নিরুত্তাপ। বিজ্ঞানের ছাত্র সায়নের অনুসন্ধানী মন দুটো নারকেল নিয়ে অনেক পরীক্ষা করে দেখেছে কিন্তু এই অস্বাভাবিক ঘটনার বৈজ্ঞানিক ব্যাখ্যা এখনো খুঁজে পায় নি । কোনো বিশেষ কারণ খুঁজে না পেয়ে , একদিন বিরোধ ঘোষিত হলো। যে গাছ কোনো কাজে আসছে না, সেটা কে রেখে লাভ কি? ওটাকে কেটে বাগানে একটা নতুন নারকেল গাছ লাগানো হোক। আর গাছ কাটার পরে , গাছের মূল কে নিয়েও একটু পরীক্ষা করার সুযোগ পাওয়া যেতে পারে।


কিশোর সায়নের কথা কেউ কানেই তোলে না। মা আর পিসি কে ভুত - প্রেতের কথা বলেই বোঝানোর চেষ্ঠা হলো কিছুদিন - "ভূত - প্রেতের সাথে এক বাড়িতে কি থাকা উচিৎ হচ্ছে? নারকেল খেতে খেতে ভূতের একঘেয়েমি আসতেই পারে আর তখন যদি আমাদের কেই নিশানা করে?'

-"ভূতের খাবার নিয়েও কি আজকাল গবেষণা চলছে?' - মেজদার কথা কানে না তুলে, সায়ন মা'কে সম্ভাব্য ভূতের উপদ্রব নিয়ে একটু সন্ধিহান করতে পেরেছিল, ঠিক সেই সময় পেছন থেকে পিসির ঠান্ডা শীতল গলা - " বিগত পঁচিশ বছর কোনো উপদ্রব কি হয়েছে? "


কৈশোর থেকে যৌবনের সরণি বেয়ে সময়ের সাথে সাথে কালো নারকেলের জন্ম রহস্য সমাধানের ইচ্ছে সায়নের মন থেকে দূরে চলে গেছে । বয়সের সাথে কৌতূহল মনের সম্পর্ক বোধহয় ব্যস্তানুপাতিক। যৌবনকে জানতে চাওয়ার তীব্রতা কে উপেক্ষা করে এখনো মাঝে মাঝে পূর্ণিমার রাতে সায়ন ছাদে গিয়ে ওই গাছের দিকে এক দৃষ্টে তাকিয়ে থাকে। মাঝে মাঝে কিছু বাদুর ও এসে ওই গাছ টায় বসে। একটা জিনিষ খেয়াল করেছে, ওই বাদুর গুলো শুধু ওই গাছ টা তেই বসে। কি এমন আছে ওই গাছে !


বৃষ্টির আলিঙ্গনে চোখ বোজা সায়নের মাথায় বিদ্যুতের ঝলক ।কৈশোরের ইচ্ছেপূরণ হবার একটা সুযোগের  আশা হটাৎ করে এসে উপস্থিত।


-"মা, তুমি ঠিক বলেছ, নারকেল গাছটার অবস্থা খুব খারাপ, যে কোনো সময় ভেঙে পরতে পারে। "- চপচপে ভেজা সায়নের চোখ দুটো জ্বলছে ।

-"এইবার গাছটার একটা ব্যবস্থা তো না করলেই নয়। ওটা ভেঙে পড়লে তো রান্নাঘর, ছাদ দুটোই যাবে। " - বাবার কথায় নিজের ভেতরের উচ্ছ্বাস কে যত টা সম্ভব চেপে রাখা যায়।


পরের এক সপ্তাহ ধরে বাড়িতে একাধিক গোলটেবিল বৈঠক। কালো নারকেল গাছের ভবিষ্যত নিয়ে। মা,পিসি আর মেজো বৌদি প্রাণপণে বাড়ির অমঙ্গল ঠেকানোর জন্য প্রায় আমরণ অনশন করতে বাকি রেখেছে। মেজো বৌদি তাঁর কোনো এক লতায় পাতায় আত্মীয়ের করুণ কাহিনীও সামনে নিয়ে এসেছে। সেই আত্মীয়ের গুরুদেবের নিষেধ অমান্য করে বাড়ির নারকেল গাছ কাটার পর সেই বাড়িতে মৃত্যু মিছিল শুরু হয়েছিল, এবং সে মিছিলে মানুষের সাথে বাড়ির তিনটে বিড়ালও ছিল। ভাগ্যিস, মায়ের গুরুদেব কোন এই রকম বিধান দেন নি।


যৌবনের গরম রক্ত, কৈশোরের অবদমিত ইচ্ছেপূরণের তীব্র আকুতি, সায়নকে বেপরোয়া করে তুলেছে। সপ্তাহ শেষের শনিবার, সায়ন পুরসভার থেকে গাছ কাটার নোটিশ নিয়ে হাজির, সাথে কিছু পারদর্শী মানুষ - গাছ কাটার। পিসি শেষ বারের মতন , সায়ন কে বোঝানোর চেষ্ঠা করে না পেরে, শুকনো চোখে হতাশ গলায় শুধু বলল - "কাজ টা বোধহয় ঠিক করলি না।' উত্তেজনার আনন্দে , পিসির বলা কথার কোনো শব্দই সায়নের কানের ত্রিসীমানায় পৌঁছতে পারে নি।


গাছ কাটার আনন্দে, সায়ন দু - দিন ঘুমোতে পারে নি। বাড়ির সব বাধা কাটিয়ে অমানিশার অন্ধকার দূর করে অবশেষে নিজের বিজ্ঞানমনস্কতার বিজয় কেতন প্রতিষ্ঠা করতে পারার সাফল্য এতদিন বাদে। দশদিনের মাথায়, জুন মাসের ভোরে প্যাঁচ প্যাঁচে গরমে হটাৎ করে আসা বৃষ্টি তে সায়ন সকালের ঘুমটাকে আরো একটু ভালোবেসে ফেলেছে আর ঠিক তখনই নীচের তলা থেকে মায়ের আর্তনাদ ঘুম টাকে তছনছ করে দিল। পিসির ঘরের দরজা ভাঙছে বড়দা আর মেজদা।


নিজের ইচ্ছে কে প্রাপ্য সম্মান দেবার পুরস্কার রূপে পিসির মৃত্যু কে মেনে নিতে পারে নি সায়ন । পরের তিন মাস নিজের সাথে নিজের অবিরাম যুদ্ধ। বিজ্ঞান ও অলৌকিক বিশ্বাসের দ্বন্দ্ব আর সেই সংঘর্ষে ছিন্নভিন্ন হওয়া মনের দৃঢ় অঙ্গীকার - নিজেকে এই বাড়ির থেকে দূরে সরিয়ে নিতে হবে। নিজেকে শাস্তি দিতে হবে এমন কিছু যাতে মৃত্যু মিছিল আটকানো যায়। মায়ের কান্না, বাবার অনুরোধ, দাদা - বৌদিদের ভালোবাসার ডাক - কোনো কিছুই সায়ন কে রাখতে পারে নি ওই বাড়ি তে।


-"বাবা, দেখ কত গুলো আম কুড়িয়েছি । তুমি কি এর থেকেও বেশি কুড়িয়েছিলে? " - ছোট্ট দিয়ার কোল ভরা সবুজ কাঁচা আম।


বাড়ির সবাই বলে দিয়াকে দেখতে নাকি ঠিক পিসির মতন ।



Comments


©2020 by Hizibizi Online

bottom of page